বিশ্ববিদ্যালয় হল থেকে বের করে দেওয়ার পর দুর্বিষহ যে অভিজ্ঞতা
১৭.০৭.২৪
আমরা যাঁরা আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলাম, তাঁদের ভোগান্তির কথা একটুখানি বলি, স্পেশালি আমার মতো যাঁরা এত দূর থেকে পড়তে এসেছি। ১৭ জুলাই হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। তখন চলছে বাংলা ব্লকেড, জায়গায় জায়গায় সহিংসতা, ছাত্রলীগের ভয়ংকর উন্মাদনা আর গোলাগুলির মতো বীভৎস ঘটনা! আমরা মেয়েরা হল ছাড়ব না, এই সিদ্ধান্তে অনড়! সব হলের মেয়েরা একমত, এমন অনিশ্চয়তায় কেউ হল ছাড়ব না।
কিন্তু হলের প্রভোস্ট, হাউস টিউটর, প্রক্টরিয়াল বডি, সবার এক কথা—হল ছাড়তেই হবে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ আছে। মেয়েদের সঙ্গে দফায় দফায় বাগ্বিতণ্ডা! প্রথমে বলছেন, সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে হল ছাড়তে হবে, যেকোনো মূল্যে। এরপরও যদি তোমরা হলে থাকো, তাহলে তোমাদের নিরাপত্তা আমরা দিতে পারব না, যদি তোমাদের কিছু হয়, সেটার দায় আমরা নেব না। আমরা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমরা হল ছাড়ব না, কিন্তু কে শোনে কার কথা!
একটু পর আবার এসে বলেন, তোমাদের ঢাকা পর্যন্ত বাস দেওয়া হবে, সেই বাসে করে সবাই চলে যাও। কত ভাবে, কত রকম করে যে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, যে পরিস্থিতি, বের হওয়া যাবে না, আমরা বের হব না। কেউ শুনছেই না আমাদের কথা, উনাদের এক কথা—বের হয়ে যাও, মরলেও রাস্তায় গিয়ে মরো, হলে না। ভাবখানা এমনই ছিল।
এরপর রাত ১০টার দিক এসে বলেন, জরুরি মিটিং হইছে তোমাদের জন্য, বাস দেওয়া হচ্ছে না, কাল সকাল পর্যন্ত থাকো, বাকি সিদ্ধান্ত সকালে জানানো হবে। সে রাতের মতো স্বস্তি যদিও পেলাম, কিন্তু সকালেই আবার শুরু খবরদারি। যেকোনো মূল্যে বের হতেই হবে, উনারা আর কিছু জানেন না।
বলা হলো, শহর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে দিয়ে আসা হবে। বাস ছাড়বে বেলা ৩টায়। বাস এল, হল সিলগালা করে সব মেয়েকে বাধ্য করা হলো হল ছাড়তে।
১৮ জুলাই, ২০২৪
এবার আসি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়...
বাড়ি ময়মনসিংহ, হলে থাকা সম্ভব না, চিটাগংয়ে আমার কোনো ধরনের আত্মীয় নেই, এই অবস্থায় দুপুরবেলা রুমে বসে ভাবছি, একটু পর বাসে উঠে শহর পর্যন্ত তো যাব ঠিকই, তারপর কোথায় যাব! কাউন্টারে ফোন দিলাম, ময়মনসিংহের বাস চলছে না। আমার এ অবস্থা দেখে রুমমেট আপু বলল, চিন্তা কোরো না, আমরা (মানে অন্য রুমমেটরা) যেখানে যাব, সেখানে তোমাকেও নিয়ে যাব, আগে বের হই! তারপর সিদ্ধান্ত হলো, রুমমেট ঐশী আপুর মামার এক বন্ধু আছেন, উনার বাসায় যাওয়া হবে। বাসা ২ নম্বর গেট, আল ফালাহ গলি।
মোটামুটি গুছিয়ে বাসে উঠলাম, কী নিদারুণ অনিশ্চয়তা। জীবনে এত অসহায় কখনো ফিল হয়নি। বাস জিরো পয়েন্টে আসার পর দাঁড়িয়ে গেল, রাস্তা নাকি ক্লিয়ার না, শহর পর্যন্তও যাওয়া যাবে না, পরিস্থিতি খুবই খারাপ। কিন্তু স্যারদের এক কথা, হলে থাকা যাবে না, যেভাবেই হোক, তোমাদের চলে যেতেই হবে।
বাস যেহেতু দাঁড়িয়ে, আমরা মেয়েরা একটু নেমে জিরো পয়েন্টের দোকানগুলো থেকে খাচ্ছিলাম, হাঁটাহাঁটি করছিলাম। এরই মধ্যে একটি ছেলে এসে টিজ করছিল আর বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করছিল। সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো, ছেলেটা একজন প্রক্টর স্যারের সামনে এটা করল, অথচ স্যার ছেলেটাকে নিজে বাঁচিয়ে নিলেন আর আমাদের থেমে যেতে বললেন। এরপর শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়ে যদিও ছেলেটাকে আটক করলেন। পরে জানতে পারলাম, বাস ছাড়ার পরপরই নাকি ছেলেটাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
ঠিক এই সময়, মাননীয় উপাচার্য তাঁর গাড়ি নিয়ে জিরো পয়েন্ট দিয়ে যাচ্ছিলেন। মেয়েরা সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ি আটকালাম। কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু কথা বলা তো দূর, গাড়িটা ব্যাক করে চলে গেল।
অনেক বাগ্বিতণ্ডার পর, জোর করেই বাসে ওঠানো হলো, কিন্তু আমি সাহস পেলাম না! আমার দুজন রুমমেট এবং আমি বাস থেকে নেমে গেলাম। মূলত, আমরা অনেক ভয় পাচ্ছিলাম শহরে যেতে, বিশেষ করে আমি কোথায় যাব সেটা স্পেসিফিক না হওয়ায়, ওখানে যে পরিমাণ দাঙ্গা–হাঙ্গামার খবর পাচ্ছিলাম, সেটাও ভয় পাওয়ার মতো যথেষ্ট ছিল।
নিপা আপু (রুমমেট) বলল, আমার এক বন্ধু, ওর পরিচিত একজন শিক্ষকের বাসায় আজকে থাকতে পারব হয়তো, স্যার আশ্বাস দিয়েছেন। এই অপশনটাই বেটার মনে করলাম, স্যারের বাসা ক্যাম্পাসেই ছিল, কিন্তু স্যার ওই বাসায় থাকতেন না, মাঝে মাঝে থাকতেন। (নাম, ডিপার্টমেন্ট না বলাটাই শ্রেয় মনে করছি। তবে স্যারের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমরা মোট ছয়জন ওই রাতে স্যারের বাসায় ছিলাম। স্যার একটাই শর্ত দিয়েছিলেন, তোমরা এখানে বসে কিছু লেখালেখি করতে পারবে না।
লিখব আর কী, তখন মোবাইল নেট বন্ধ। শুধু ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু। দুঃখের বিষয়, স্যার পাসওয়ার্ড দিয়ে যাননি। সারা রাত কী অস্থিরতার মধ্যে গেল! সবার ফোনেই উড়ু উড়ু খবর পাচ্ছিলাম, রাস্তায় কী কী হচ্ছে, ছাত্রলীগ কী করছে, শিক্ষার্থীদের মেস, কটেজে গিয়ে গিয়ে!
অনেক উৎকণ্ঠার মধ্যে সিদ্ধান্ত নিলাম, ভোরবেলা স্যারের বাসা ছেড়ে যে যার দিকে যাব। আশা করি, সকালবেলা কোনো ঝামেলা রাস্তায় থাকবে না। ৬টার দিকে বের হয়ে গেলাম। জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত হেঁটেই এলাম, কথা ছিল ঐশী আপুর মামার বন্ধুর বাসায় যাওয়ার। সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে যখন লেভেলক্রসিং এলাম, তখন দেখলাম ময়মনসিংহের এক বন্ধু ময়মনসিংহ যাচ্ছে ট্রেনে।
সিএনজি থেকে নেমে গেলাম অন্য আপুদের বিদায় জানিয়ে। কিন্তু সমস্যা একটাই, টিকিট করতে হয় ১০ দিন আগে, আমি তো করিনি। আর এই প্রথমবারের মতো টিকিট ছাড়া যাচ্ছি, তা–ও একা, দেশের এই পরিস্থিতি, কী হবে না হবে, কিছু জানি না। আল্লাহর নাম নিয়ে সিএনজি রিজার্ভ করলাম লেভেলক্রসিং থেকেই নিউমার্কেটের জন্য। উদ্দেশ্য, আগে গিয়ে যদি কাউন্টারে একটা টিকিট মেলে!
কিন্তু না, পারিনি। সব টিকিট নাকি শেষ। কী আর করা, মন একটু খারাপ হলেও ভাবলাম, আগে উঠি তো ট্রেনে, তারপর যা হবে, দেখা যাবে।
প্রায় দুই ঘণ্টা পরে ট্রেন এল। চিন্তা হচ্ছিল, আমি উঠব কোন বগিতে। একটি এসি বগিতে ঢুকব, এ সময় ভাবলাম, রেলের স্টাফদের কাছে ব্ল্যাকটিকিট থাকবে হয়তো। কথা বলে দেখতে তো ক্ষতি নেই। রেলের স্টাফকে বলার পর উনি বললেন, ২৫, ২৬, ২৮ ও ২৯ যেকোনো একটি সিটে বসে পড়েন, পরে আমি আসছি। বললাম, টাকা? উনি বললেন, পরে। আগে বসেন।
বগিতে ঢুকে দেখলাম, চার সিটের তিনটিতে কেউ না কেউ বসে আছে। বাকি একটিতে আমি বসলাম। ওই দিন ৪৬০ টাকার ভাড়া ৭৫০ টাকা দিতে হয়েছিল। তা–ও ভালো।
সকাল সাড়ে ১০টায় ট্রেন ছাড়ল, বেলা ১টা ১৪ মিনিটে কুমিল্লা এসে থামল। ভাবলাম, একটু পর তো ছেড়েই দেবে। কিন্তু না, সামনে নাকি সংঘর্ষ হচ্ছে পুলিশ, ছাত্রলীগ আর বিএনপির মধ্যে। যদিও সঠিক কী হয়েছিল জানি না, তবে ট্রেনে বসে এই উড়ো খবরটাই পাচ্ছিলাম। দুর্বৃত্তরা রেললাইন কেটে রাখতে পারে, আগুন দিতে পারে, লাইন ক্লিয়ার না, আরো কত অ্যাজাম্পশন! সবকিছু মিলিয়ে ট্রেন বন্ধ।
এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সন্ধ্যা, রাত হয়ে গেল। আমরা কুমিল্লাতেই বসে। একসময় জানানো হলো, ট্রেন চলবে না। এরই মধ্যে আমার বন্ধু সুইটি, ওর বাড়ি কুমিল্লা। ফোন করে বলল, বাসায় চলে আয়। আমি বললাম, এতগুলা মানুষ যা করবে আমিও তা–ই করব। দেখা যাক, একেবারে উপায় না পেলে ফোন করব। আমাকে নিতে স্টেশনেও সে এসেছিল, আমি দেখা করে ওকে পাঠিয়ে দিয়েছি।
যখন জানলাম, ট্রেন আর চলবে না, তখন অনেকেই নেমে যাচ্ছিল, কিন্তু আমি ভাবছিলাম, সড়কপথেও যাওয়া সম্ভব না।
এদিকে ট্রেনও চলছে না, ওদিকে বাসও চলছে না, আমি আছি তখন একা একটা মেয়ে মাঝরাস্তায়, রাত তখন ১০টা! কই যাব, কী করব, কিচ্ছু জানি না! ট্রেনেই বসে আছি, ভাবছি, ট্রেন যেখানে যাবে, আমিও সেখানেই যাব।
আল্লাহর কী রহমত, সাড়ে ১০টায় জোরে হুইসেল বাজল, মানে ট্রেন চলবে! প্রায় ১০ ঘণ্টা পর কুমিল্লা থেকে ট্রেন ছাড়ল। এত খুশি হয়েছিলাম, কী বলব! শুকরিয়া আদায় করলাম!
ট্রেন ছাড়লেও আখাউড়া এসে আবার স্টপেজ দিল। আর যাবে না! ওখানেও প্রায় ঘণ্টাখানেক বসে থাকার পর আবার ছাড়ল ট্রেন। রাত ১২টার দিক শুনলাম, কারফিউ জারি হয়েছে।
এক টেনশন যেতে না যেতে আরেক টেনশন এসে হাজির! ট্রেন ময়মনসিংহ এসে পৌঁছালেও সেখান থেকে আমার বাড়ি কীভাবে যাব যদি কারফিউ থাকে? যদি কোনো গাড়ি না চলে?
আখাউড়ার পর থেকে ট্রেন খুব স্পিডে চলছিল। ধরে নিয়েছিলাম ভোর ৪টা নাগাদ ময়মনসিংহে পৌঁছাব। আমার টেনশন ছিল, তখনো অন্ধকার থাকবে, কী করব। পরে ভেবে রেখেছিলাম, অন্ধকার থাকলে স্টেশনে বসে থাকব, আলো ফুটলে তখন বের হব।
ফজরের আজানের একটু পর পৌঁছালাম ময়মনসিংহে। তখনো আবছা অন্ধকার। সাহস করে বের হলাম স্টেশন থেকে। দেখলাম, খুবই কম, তবু কিছু গাড়ি আছে। রিকশা নিয়ে ব্রিজে এলাম, ভাড়া অনেক বেশি নিল। ব্রিজ থেকে তারাকান্দা, আর সেখান থেকে বাড়ি পর্যন্ত এলাম।
বাড়ি পৌঁছালাম ১৯ তারিখ ভোর ৬টায়। মানে এর মধ্যে ২৪ ঘণ্টার দুর্বিষহ সময় পার হলো। আজকে আমি বাড়ি অনেক ঝক্কি–ঝামেলার মধ্যেও পৌঁছাতে পেরেছিলাম, এ জন্য আলহামদুলিল্লাহ! কিন্তু যদি রাস্তায় কিছু হতো সেই দায় কে নিত?
এরপরেও হলে দায়িত্বরত প্রভোস্টদের পদত্যাগ করতে হচ্ছে বলে মায়াকান্না কাঁদবেন? আমি আসলে এগুলো বলতে চাচ্ছিলাম না, কিন্তু পরে আবার মনে হলো, না বললে মানুষ জানবে কীভাবে? হলের মেয়েদের কিসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল!
* লেখক: ইফফাত জাহান শারমিন, প্রীতিলতা হল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]