তরুণ উদ্যোক্তাদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রয়োজন
স্বল্প আয়তনের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার এ দেশে আর্থসামাজিক উন্নয়নের চিত্র যতটা না দৃশ্যমান, তার থেকে অভাব–অনটনের বিষয়টি বেশি চিত্রায়িত। তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি চাকরির পেছনে সবার অবিরাম ছুটে চলা। প্রতিবছর সরকারি বিভিন্ন চাকরিতে আবেদন করেন লাখো চাকরিপ্রার্থী।
কয়েক শ বা কয়েক হাজার পদের বিপরীতে আবেদন করেন লাখো প্রার্থী। এ দেশে একটি সরকারি চাকরি মানেই যেন সোনার হরিণ। বেতন বা সুযোগ-সুবিধা তেমন কোনো বিষয় নয়। শুধু একটি সরকারি চাকরি পেতে সব ধরনের ত্যাগে রাজি চাকরিপ্রার্থীরা। বাংলাদেশে সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সরকারি চাকরি হলো বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ক্যাডারভিত্তিক একটি পদ।
সবকিছু ছেড়ে শুধু বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য একটানা চার থেকে পাঁচ বছর চেষ্টা করে যান বহু শিক্ষার্থী। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ৪৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে আবেদন করেছিলেন ৩ লাখ ৫০ হাজার ৭১৬ জন। পিএসসি সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়েছিল ৪১তম বিসিএসে। ওই বিসিএসে ৪ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি প্রার্থী আবেদন করেছিলেন।
৪৩তম বিসিএসে আবেদন পড়েছিল ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯০টি। আবেদনের হিসাবে ৪৩তম বিসিএস দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ব্রুনেই, বাহামা, আইসল্যান্ড, বার্বাডোজ, সেন্ট লুসিয়া, গ্রেনাডাসহ কয়েকটি দেশের জনসংখ্যাও এত নয়, যতজন ৪৩তম বিসিএসে আবেদন করেছিলেন।
অর্থাৎ, বাংলাদেশে বিসিএসসহ সমস্ত সরকারি চাকরি নিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে একটা উন্মাদনা কাজ করে। প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের মতো একটি সম্ভাবনাময় দেশে নতুন কিছুর উদ্যোগ গ্রহণ না করে সবাই সরকারি চাকরির পেছনে ছোটেন কেন? উত্তর খুবই সহজ ও সোজা। সেটা হলো সরকারি চাকরিতে যে সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা, সেটা উদ্যোক্তা হলে পান না।
একজন সরকারি চাকরিজীবী মাস শেষে নির্দিষ্ট পরিমাণে বেতন পান। বিভিন্ন উৎসবে বেতনের সঙ্গে অতিরিক্ত বোনাস পান। যদি কখনো কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় বা প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তবুও তাঁর মাসিক বেতন সচল থাকে। অর্থাৎ, মাস শেষে নির্দিষ্ট পরিমাণে বেতন তিনি পাবেনই। কিন্তু উদ্যোক্তা হলে উল্টো ভয় কাজ করে।
বাংলাদেশে সামাজিকভাবেই কেউ কারও ভালো দেখতে পারে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়ত দেখি যে বিদেশফেরত অনেকেই দেশে এসে নিজ উদ্যোগে সমন্বিত কৃষি প্রকল্প শুরু করলে গ্রামের কতিপয় মন্দ লোকের কারণে সেটা আলোর মুখ দেখে না বা দেখতে দেওয়া হয় না।
২০২১ সালের মার্চ মাসে বাগেরহাটে সোহাগ নামের একজন ১ একর ৩২ শতাংশ জায়গায় ৩ লাখ টাকা খরচ করে ১৩ শ কলাগাছের পরিচর্যা করলে ১ হাজার কলাগাছে প্রায় ৬ থেকে ৮ লক্ষ টাকার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু দুর্বৃত্তরা তাঁর সমস্ত কলাগাছ কেটে ফেলে। এর ফলে পথে বসতে হয় সোহাগকে।
দুই বছর আগে নওগাঁয় প্রায় এক শ আম্রপালি গাছ লাগিয়েছিলেন জালাল উদ্দিন। তাঁর সব গাছ রাতে কে বা কারা কেটে ফেলে, তা কেউ জানেন না। আবার নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলায় এক বাগানির ৮০টি আমগাছ পূর্বশত্রুতার জেরে কেটে ফেলে দুবৃত্তরা। এ রকম অনেক খবর আমরা প্রতিনিয়ত টেলিভিশনে বা পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই।
একজন উদ্যোক্তা প্রাথমিক অবস্থায় টাকা ধার নিয়ে একটি প্রকল্প দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। এমনিতেই বেকার কাউকে কোনো ব্যাংক, এনজিও বা ব্যক্তি টাকা দিতে চান না। এর মধ্যে কেউ সফল হতে যাচ্ছেন, এমন অবস্থায় শত্রুতা করে তাঁর প্রকল্পটি ধ্বংস করে পথে বসানো হয়।
বাংলাদেশে কৃষি, মৎস্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের সংখ্যা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে, যদি তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। উদ্যোক্তাদের সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর তাঁদের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক অর্থ সরকার থেকে সহায়তা করলে দেশে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে।
এ দেশে হাজারো যুবক নিত্যনতুন আইডিয়া নিয়ে ঘুরে বেড়ান। প্রাথমিক পুঁজি আর নিরাপত্তার ভয়ে তাঁরা সামনে আগানোর সাহস পান না। যাঁরা সাহস করে সামনে আগান, শত্রুতা বা পূর্বশত্রুতার জেরে অনেকেই ক্ষতির সম্মুখীন হন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। এখন প্রয়োজনীয় প্রাথমিক প্রশিক্ষণ, সহোযোগিতা ও সুষ্ঠু নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে পারলেই বাংলাদেশে এক নতুন বিপ্লবের সৃষ্টি হবে। আর সেই বিপ্লব হবে স্বয়ংসম্পূর্ণতার বিল্পব।
লেখক: মো. শফিকুল ইসলাম নিয়ামত, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।