বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও রাখাইনে মানবিক করিডর
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের আহ্বানে বাংলাদেশ মানবিক করিডর চালুর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে মানবিক বিবেচনায় একটি ইতিবাচক উদ্যোগ বলে মনে হতে পারে। তবে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় এর অন্তর্নিহিত বিপদ অবহেলা করা কোনোভাবেই বাংলাদেশের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
বিশ্ব ইতিহাস বলে, মানবিক করিডর কখনোই নিছক ত্রাণ সরবরাহের পথ হয়ে থাকেনি। বরং বারবার তা হয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠী, বিদ্রোহী সংগঠন ও অপরাধী চক্রের জন্য একটি নিরাপদ পথ। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় জাতিসংঘের মানবিক করিডর গণহত্যা রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল; সেখানে তা উল্টো হত্যাকারী মিলিশিয়াদের আস্তানায় পরিণত হয়। বসনিয়ায় জাতিসংঘ-ঘোষিত ‘সেফ এরিয়া’ সেব্রেনিৎসায় হাজারো মুসলিমকে গণহত্যার জন্য কেন্দ্রীভূত করা হয়েছিল। সিরিয়ায় বহু মানবিক করিডর বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অস্ত্র, অর্থ ও প্রভাব বাড়ানোর রুটে পরিণত হয়।
রাখাইনের বর্তমান বাস্তবতা আরও জটিল। সেখানে কোনো স্বীকৃত প্রশাসন নেই। আরাকান আর্মিসহ নানা বিদ্রোহী সংগঠন ও অপরাধী চক্র সক্রিয়। জান্তা সরকার নিজেই রাখাইনে অবরোধ সৃষ্টি করে সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ করে রেখেছে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ হয়ে পাঠানো ত্রাণ প্রকৃতপক্ষে বেসামরিক লোকদের কাছে পৌঁছাবে তো? নাকি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে পড়ে যাবে?
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের আশঙ্কা অমূলক নয়। রাখাইন সীমান্ত অঞ্চল বহুদিন ধরেই মাদক ও অস্ত্র পাচারের আন্তর্জাতিক রুট। মানবিক করিডরের ছত্রচ্ছায়ায় এই অবৈধ প্রবাহ বেড়ে গেলে তা দেশের ভেতর অস্ত্রসংকট ও অপরাধপ্রবণতা বাড়াতে পারে। এমনকি করিডর চালুর পর নতুন করে রোহিঙ্গা স্রোতের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৩-১৪ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে; রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন তো দূরের কথা, গত কয়েক মাসে দেশে দেড় লাখ নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে। রাখাইনে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটলে সীমান্ত পেরিয়ে অভিবাসন স্রোত ফের শুরু হতে পারে, যা দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক ভারসাম্যে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করবে।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে সরাসরি আক্রমণ করে বলেছেন, ‘এই সিদ্ধান্ত দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলবে। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া অনুচিত ছিল; বরং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। আমরা আরেকটি গাজায় পরিণত হতে চাই না, আমরা আরেকটি যুদ্ধ চাই না।’
তাঁর এই মন্তব্য মোটেই উপেক্ষণীয় নয়। বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণে এমন স্পর্শকাতর সিদ্ধান্তে গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তি জরুরি ছিল। অন্যদিকে প্রশ্ন উঠছে, কেন শুধু বাংলাদেশকেই মানবিক করিডর খোলার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে? মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ভারতের মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্যের, আছে চীনের ইউনান প্রদেশও। সেখানে মানবিক করিডর খোলার উদ্যোগ কই? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কি বাংলাদেশকেই বারবার সহজ লক্ষ্যবস্তু বানাতে চায়?
এখানে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট হওয়া জরুরি মানবিক করিডরের প্রশ্নে বাংলাদেশের কোনো একক দায় নেই। রোহিঙ্গা সংকটে অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে, কেবল মানবিকতার দোহাই দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন করা চলবে না। বাংলাদেশের সীমিত ভূখণ্ড ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা এর বেশি বোঝা বইতে পারবে না।
এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী?
১. মানবিক করিডরের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটি জাতীয় নিরাপত্তা মূল্যায়ন জরুরি
২. জাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তিতে শক্ত শর্তাবলি ও ত্রাণ বিতরণে সরাসরি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা
৩. ভারতের মিজোরাম ও চীনের ইউনান সীমান্তকেও মানবিক করিডরের অংশ করার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি
৪. সীমান্ত নজরদারি ও মাদক পাচার রোধে বিশেষ নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ
৫. জাতির ভবিষ্যৎ স্বার্থ বিবেচনায় জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণ।
বাংলাদেশ মানবিক দায়িত্ব পালনে পিছিয়ে থাকতে চায় না, কিন্তু অন্যের যুদ্ধের দায়ভার বহন করা কোনোভাবেই আমাদের মেনে নেওয়া উচিত নয়। মানবিক করিডর যদি বাস্তবিক অর্থে অস্ত্র ও অপরাধের করিডরে পরিণত হয়, তবে তা বাংলাদেশের জন্য হবে এক দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয়ের সূচনা। সতর্কতার আজই সময়। পরে অনুতাপের সুযোগ না–ও থাকতে পারে।