দুই আন্দোলনে বন্ধ শিক্ষাঙ্গন, কোন পথে আমরা

কোটা বাতিলের দাবিতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক আটকিয়ে আন্দোলন করছেন বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষার্থীরা। নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড, বরিশাল সদর, ৭ জুলাইছবি: কামরুল হাসান

করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে যখন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে আসার চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক–কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি এবং একই সময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। চলমান এ আন্দোলন দীর্ঘায়িত হলে সেশনজটের আশঙ্কায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এদিকে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা কঠোর আন্দোলনের দিকে গেলে এর প্রভাব স্কুল-কলেজ ও চলমান এইচএসসি পরীক্ষার ওপর পড়বে। ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় চরম বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে শিক্ষকদের আন্দোলনে চলমান জিএসটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। একই সঙ্গে কৃষিগুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনের চতুর্মুখী আন্দোলনে কোন পথে এগোবে দেশ?

অর্থ মন্ত্রণালয়ের পেনশনসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, প্রতিশ্রুত সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্মবিরতি ও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনে কার্যত স্থবির হয়ে রয়েছে দেশের সর্বোচ্চ এ শিক্ষাঙ্গন। বছরের এ সময়টিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলে টার্ম ও সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। গুরুত্বপূর্ণ এ পরীক্ষা বন্ধ থাকায় সেশনজটের আশঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

শিক্ষকদের এ আন্দোলনে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। এ ছাড়া চলমান জিএসটি গুচ্ছ ভর্তি কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে রয়েছে। এদিকে দাবি মেনে না নিলে কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা না নেওয়ার ঘোষণা দেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।  শিক্ষকদের আন্দোলন নিবৃত্ত করতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করার কথা থাকলেও রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ততার অজুহাতে বৈঠকটি স্থগিত হয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উচিত শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে সমাধানের দিকে যাওয়া, নাহয় পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশ যখন উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে বিপর্যস্ত হবে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণা কার্যক্রমসহ পুরো শিক্ষাব্যবস্থা।

এদিকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা-২০২৩–এর প্রজ্ঞাপন হতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার ও কর্মকর্তাদের জন্য ইউজিসির সুপারিশকৃত অভিন্ন নীতিমালায় ১২ দফা সংযোজনের দাবিতে বাংলাদেশ আন্তবিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বানে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা পূর্ণ দিবস কর্মবিরতির  কারণে অফিস, একাডেমিকসহ সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়েছে। এতে অচলাবস্থা বিরাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এ ছাড়া পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে বাংলাদেশ আন্তবিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সমিতির ডাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরাও কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। এককথায় যদি বলি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শাটডাউন পরিস্থিতি চলছে।

২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে (৫৬ শতাংশ) কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর পর থেকে টানা সাড়ে পাঁচ বছর কোনো কোটা ছাড়াই নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগ হয়। ২০২১ সালে ওই পরিপত্রের ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল হওয়ার অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট করেন। ৫ জুন এই রিটের রায়ে পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে শুরু হতে থাকে নানা আলোচনা-সমালোচনা এবং বিক্ষোভ ও আন্দোলন। চলছে বাংলা ব্লকেড। কোটা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। কোটা বাতিলের দাবিতে রাস্তা অবরোধ, বিক্ষোভ-মিছিলসহ নানা কর্মসূচিতে মুখর ক্যাম্পাসগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও কোটা সংস্কারের পক্ষে ফেসবুক ও সংবাদমাধ্যমে নিজেদের মতামত প্রকাশ করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন।

২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার কোটা বাতিল করে। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা এখনো সম্পূর্ণ কোটা বাতিল চান না। তাঁরা চান মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানার্থে কিছু নির্দিষ্ট কোটা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা রাখতে। দেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যদি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করে নেন, তবে সেটা হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। তবে গত আন্দোলনের পর্যালোচনা থেকে বলতে পারি, কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন যদি দীর্ঘায়িত হয়, তবে দেশ একটি ঘোলাটে পরিস্থিতির দিকে এগোবে।

কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একেক করে একাত্মতা পোষণ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। শিক্ষার্থীরাও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও সংবাদমাধ্যমে। যদি শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মাচারীরা এক হয়ে আন্দোলনের দিকে এগিয়ে যান; তবে পরিস্থিতি চলে যেতে পারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এ ছাড়া কোটা আন্দোলনের প্রভাব পড়া শুরু করেছে দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও জেলা শহরগুলোতে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও কোটা বাতিলের দাবিতে মাঠে নেমে আন্দোলনের চিন্তা করছেন। যদি আলোচনায় কোটা সমস্যার সমাধান না হয়, তবে কোন পথে এগোবে দেশ? দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাঁচাতে এবং শিক্ষাঙ্গনের শাটডাউন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

*লেখক: শেখ সাদী ভূঁইয়া, শিক্ষার্থী, ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর