কূটনীতিতে আশার বার্তা ও ভবিষ্যতের নতুন দিক
বাংলাদেশের কূটনৈতিক পরিসরে সাম্প্রতিক দুটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি আমাদের সামনে নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। প্রথমটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্কনীতি–সংক্রান্ত আলোচনায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সক্রিয় ভূমিকা এবং দ্বিতীয়টি মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত যাওয়ার যোগ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট একটি সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে মুহাম্মদ ইউনূস যে প্রস্তাব দিয়েছেন—৯০ দিনের জন্য পারস্পরিক শুল্কনীতি (reciprocal tariff) স্থগিত রাখা, তা যুক্তরাষ্ট্র সরকার ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে দেখা গেছে, তারা আপাতত শুল্কনীতি স্থগিত রেখেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় কূটনৈতিক অর্জন, যা শুধু ইউনূসের ব্যক্তিগত সুনাম নয়, বরং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতারও প্রতিফলন।
এদিকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক দমন-পীড়নের কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ৮ লাখের অধিক রোহিঙ্গার প্রত্যাবর্তন আজও অনিশ্চিত রয়ে গেছে। তবে সম্প্রতি ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউ থান শিউ ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত যাওয়ার যোগ্য। আরও ৭০ হাজার রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াধীন। ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ছয়টি ধাপে যে তালিকা মিয়ানমারকে দিয়েছে, এই প্রত্যাবর্তন পরিকল্পনা তারই পরিণতি। এটিই প্রথমবারের মতো মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে এ কথা বলা হলো, যা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
এ দুটি ঘটনা মিলিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে—বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিসরে এখন আর প্রান্তিক কণ্ঠস্বর নয়। বরং আন্তর্জাতিক ফোরামে আমাদের কূটনৈতিক দক্ষতা, মানবিক নেতৃত্ব এবং ধৈর্যের পরিচয় নতুনভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, শান্তিরক্ষা, অভিবাসনসহ বহু ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন অধিক আত্মবিশ্বাসী ও দায়িত্বশীল।
তবে এই কূটনৈতিক অর্জনকে টেকসই করতে হলে আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণ শক্তি এবং সামাজিক কাঠামোকে আরও সুদৃঢ় করতে হবে। দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ তরুণ জনগোষ্ঠী। বিডার চেয়ারম্যানের তথ্যমতে, বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষের গড় বয়স মাত্র ২৫ বছর। এই বিপুল জনশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা, মৌলিক গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো এবং প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা চালুর উদ্যোগ নিতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে এবং শিক্ষাক্রমে দেশপ্রেম, সততা ও দুর্নীতিবিরোধী মানসিকতা তৈরির উপযোগী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্যোগে আয়োজিত বিনিয়োগ সম্মেলন এক নতুন দিক নির্দেশ করছে—দেশকে শুধু চাকরির জন্য প্রস্তুত কর্মী নয়, বরং উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী নাগরিক গড়ে তোলার বার্তা দিচ্ছে এই আয়োজন।
তবে নেতৃত্ব দিয়ে শুধু রাষ্ট্র বদলায় না—প্রয়োজন সমন্বিত সামাজিক চেতনা, সুশাসন এবং নৈতিক কাঠামো। শিক্ষা, প্রশাসন, গণমাধ্যম ও রাজনীতিতে ইতিবাচক সংস্কার জরুরি। মানুষকে রাষ্ট্রের মালিকানার অনুভূতি দিতে হবে। রাষ্ট্র মানেই আমি—এই মনোভাব গড়ে তুলতে হবে প্রজন্মের মধ্যে।
বাংলাদেশ আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে—যেখানে নেতৃত্ব, সম্ভাবনা এবং আন্তর্জাতিক সুযোগ একসঙ্গে দেখা দিয়েছে। আমাদের উচিত হবে এই সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগিয়ে আত্মবিশ্বাস ও দূরদর্শিতার সঙ্গে সামনে এগিয়ে যাওয়া। ড. ইউনূস ও রাষ্ট্রীয় কূটনীতির যৌথ এই অগ্রগতি প্রমাণ করে, আমরা চাইলে পারি। এখন প্রয়োজন শুধু সবার সম্মিলিত সদিচ্ছা, নেতৃত্বের প্রজ্ঞা এবং জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ।
লেখক: অধ্যাপক মো. ফজলুল করিম, বিজিই বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল।