বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া নারীকে বিয়ে করেছি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমি জেনেবুঝে সুস্থ মস্তিষ্কে ওই মেয়েকে বিয়ে করেছি। এতে আমার সমস্যা বা অসুবিধা কোনোটাই নেই। কিন্তু এ নিয়ে আমার চারপাশের মানুষের সমস্যার শেষ নেই। চিন্তায় তাঁদের কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে!

বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া মেয়েকে বিয়ে করেছি বলে সব সময় বউকে নিয়ে অপমানজনক কথা শুনতে হয়। যে যেমন করে পারে, যেভাবে পারে, দুয়েকটা কথা শুনিয়ে যায়। সুযোগ পেলেই খোঁচা দেয়! অনেকে বলে, তুমি তো অবিবাহিত, তাহলে জেনেশুনে এ রকম একটা বিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করলে কেন? এমন বিব্রতকর প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছি!

সবচেয়ে খারাপ লাগে, যখন আমার অগোচরে আমাকে নিয়ে ভীষণ রকম আপত্তিকর এবং নগ্ন কথা বলে। আমকে শুনিয়ে শুনিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর হাসাহাসি করে। সরাসরি সামনে কিছু বললে এতটা খারাপ লাগে না! আশ্চর্য ব্যাপার হলো, এসব কথা বলা মানুষেরা অধিকাংশই উচ্চশিক্ষিত ও পরিচিত!

শুরুটা হয়েছে বিয়ের পরে, প্রথম যখন বাড়িতে গিয়েছি, তখন থেকে। আমার বউয়ের আগে বিয়ে হয়েছিল, সেটা মা-বাবা আগে থেকেই জানে। তাদের অনুমতি নিয়ে একা একাই বিয়ে করেছি। বিয়ের মাসখানেক পর নতুন বউকে নিয়ে বাড়ি গিয়েছি। এ উপলক্ষে বাবা বাড়িতে বিশাল আয়োজন করেছে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি—সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে অনেকে বিদায় নিয়েছে।

বিকেলের দিকে আমার এক দূরসম্পর্কের ফুফু বলে, এই মেয়ের তো আগে বিয়ে হয়েছিল, কীভাবে যেন আগের বিয়ের একটা ছবি তিনি বের করেছেন। এর পাঁচ মিনিটের মধ্যে সবার মুঠোফোনে সেই ছবি চলে যায়। পরিবারের আপন কিছু সদস্য থেকে কাকি, মামি, খালা, ফুফু, পাড়া-প্রতিবেশী নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত!

তারপর বিকৃত কথার বাণে আমাদের তুলোধুনো করতে থাকে। চিরাচরিত বাঙালি স্বভাব, অন্যের দুর্বলতায় খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঘাত করে পাশবিক মজা নেয়। তারা যে শুধু আমাকে বলেই খান্ত দেয় তা নয়, মা-বাবাকে ডেকে এসব অপমানজনক বর্ণবাদী কথা শোনায়।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

আমার নতুন বউ শ্বশুরবাড়িতে এসে আক্রমণাত্মক কুরুচিপূর্ণ এসব কথা নীরবে হজম করে আর নীরবে চোখের জল ফেলে। সদাহাস্যোজ্জ্বল মেয়েটা রুম থেকে বাইরে বের হয় না, এতিমের মতো বিছানার এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে। স্বামী হিসেবে তাকে আগলে রাখা এবং নিরাপত্তা দিতে আমি বাধ্য। আসলে লাঠিওয়ালার লাঠি ঠেকানো যায়, কিন্তু মানুষের মুখের কথা ঠেকানোর যায় না। অবশেষে পরদিন রাতে বাবা একটা গাড়ি ম্যানেজ করে আমাদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়।

আমার ভাগ্য, এ রকম একটা মেয়েকে বউ হিসেবে পেয়েছি। ওর নাম তনিমা। দেখতে ভীষণ মিষ্টি। রূপে-গুণে অনন্য। সরকারি মেডিকেল থেকে ডাক্তারি পড়েছে। পড়াশোনার শেষের দিকে মা-বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে। বিয়েতে যে তার অমত ছিল, তেমন নয়। ডার্ক টল হ্যান্ডসাম চিকিৎসক ছেলে, ভালো চাকরি করে, পরিবার ভালো, বিয়ের পর মেয়ের চাকরি করতে আপত্তি নেই—এসব কথায় রাজি হয় তনিমা। আজ হোক, কাল হোক বিয়ে তো করতেই হবে, তাহলে এমন ছেলেকে না করার মানেই হয় না!

অতঃপর মহা ধুমধামে বিয়ে হয়। কিন্তু এক মাস সংসার করতে না করতেই তনিমা বুঝতে পারে দূরসম্পর্কের এক খালাতো বোনের সঙ্গে এই ছেলের সম্পর্ক আছে। এর পর থেকেই সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। বছর ঘোরার আগেই বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বিচ্ছেদের এক মাসের মাথায় সেই ছেলে তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে। তারপর তনিমা একটা বেসরকারি হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে চাকরি শুরু করে। সেখানেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় থেকে প্রণয়।

বিয়ের আগে তনিমার কাছে থেকে এসব শুনেছি। তারপর এ নিয়ে কখনো কোনো কথা বলিনি। শুধু অনুরোধ করেছিলাম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডিগুলো বন্ধ করে নতুন আইডি চালু করতে, যাতে আগের ছবি কিংবা মেমোরি না থাকে। আগের ছবি দেখলে মানুষ আমাদের নিয়ে বেশি কথা বলবে। সে তাই করেছে, কিন্তু তাতে আমাদের শেষ রক্ষা হয়নি।

এরপর অনেক দিন চলে গেছে। প্রায় দুই বছর পর আমরা আবার বাড়ি যাচ্ছি। ইতিমধ্যে মানুষের কথা আমাদের সয়ে গেছে। এখন তেমন কিছু মনে হয় না। মা-বাবা তাদের অকৃতজ্ঞ স্বজনদের ছাঁটাই করে ফেলেছে। তনিমার দেহের মধ্যে নতুন জীবনের আগমনের খুশিতে আমরা সব ভুলে গেছি। চিকিৎসক বলেছে প্রাথমিক এ সময়ে জার্নি করা ঠিক হবে না।

কিন্তু তনিমার ইচ্ছা কয়েক দিন সে গ্রামের খোলামেলা পরিবেশে থাকবে। তাই তাকে নিয়ে স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। ইচ্ছা ছিল এসি কেবিনে যাওয়ার, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও টিকিট ম্যানেজ করতে পারিনি। তবে কেবিনের তিনটি টিকিট কেটেছি, রুম শেয়ার করে যেতে হবে। তাতে তনিমার সমস্যা নেই, মাত্র তিন ঘণ্টা, দেখতে দেখতে চলে যাবে।

বিমানবন্দর রেলস্টেশনে যথাসময়ে ট্রেন আসে। আমি তনিমাকে নিয়ে সাবধানে ট্রেনে উঠি। কেবিনে ঠুকতেই লাফ দিয়ে উঠে সে। মনে মনে ভাবি, এসির অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণে এ রকম হতে পারে। তা ছাড়া এ সময়ে মেয়েরা বিশ্রী সব গন্ধ অনুভব করে। সে জন্যও এ রকম হতে পারে। আমি আস্তে করে ওকে সিটে বসিয়ে দিই। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করি, তনিমা এসির মধ্যেও দরদর করে ঘামছে। ট্রেন চলতে শুরু করে।

আমাদের সামনের সিটে বসে আছে এক দম্পতি, সঙ্গে ফুটফুটে এক কন্যা। তাদের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলি, আমার মিসেস প্রেগন্যান্ট, তাই সে একটু শুয়ে পড়েছে আপনারা কিছু মনে করবেন না। তনিমা আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। আমি ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চিন্তা করি, জীবনের প্রবাহ টিকিয়ে রাখতে একটা মেয়ে কী পরিমাণ কষ্ট সহ্য করে!

কিছু সময় পর ওই দম্পতি রুম থেকে বেরিয়ে যায়, হয়তো ওয়াশরুমে যাবে। তনিমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সাবলীলভাবে বলে, ওই লোকটা আমার সাবেক স্বামী! আমি খানিকটা এলোমেলো হয়ে যাই। তার মানে, কামরার চারজনের মধ্যে তিনজনই পূর্বপরিচিত! কী কাকতালীয়!

নিজেকে সামলে নিয়ে তনিমার হাত শক্ত করে ধরে বলি, আমিই তোমার স্বামী। এর আগেও কেউ ছিল না, এরপরও কেউ নেই। পরজন্মে আমি হুর চাই না, তোমাকে চাই। সে আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখের কোণ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পরে!