উদ্ভাবননির্ভর প্রবৃদ্ধি: জোয়েল মোকির, ফিলিপ আগিয়োঁ ও পিটার হাউইট তত্ত্ব এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ব অর্থনীতি এক গভীর রূপান্তরের মধ্য দিয়ে চলছে। আগে যেখানে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি মূলত পুঁজির সঞ্চয় ও শ্রমশক্তির ওপর নির্ভরশীল ছিল, এখন জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনই অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। আধুনিক বিশ্বের টেকসই উন্নয়ন অর্জনকারী দেশগুলো তাদের নীতিমালায় উদ্ভাবনকে কেন্দ্রীয় স্থানে রেখেছে। প্রথম শিল্পবিপ্লব থেকে শুরু করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব পর্যন্ত প্রতিটি অর্থনৈতিক রূপান্তরের মূল ভিত্তি ছিল জ্ঞানের বিস্তার, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ।
বাংলাদেশ তার দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে এখন এক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। শিল্প খাতে প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতা এখনো কাটেনি; দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের জন্য দেশকে শ্রমনির্ভর উৎপাদন থেকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হতে হবে। নীতিগত অনিশ্চয়তা, প্রশাসনিক জটিলতা এবং বিনিয়োগ পরিবেশে অস্থিরতা উদ্যোক্তা উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই প্রেক্ষাপটে ২০২৫ সালের নোবেল অর্থনীতিতে বিজয়ী জোয়েল মোকির, ফিলিপ আগিয়োঁ ও পিটার হাউইটের তত্ত্ব বিশেষ প্রাসঙ্গিক।
উদ্ভাবননির্ভর প্রবৃদ্ধির ধারণা—
অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ জোয়েল মোকির দেখিয়েছেন যে জ্ঞান, সংস্কৃতি এবং সমাজের মননশীলতা উদ্ভাবনের মূল ভিত্তি। তাঁর মতে, কোনো সমাজ তখনই প্রকৃত প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অর্জন করতে পারে, যখন সেখানে জ্ঞানের মুক্ত প্রবাহ, অনুসন্ধানী মানসিকতা এবং গবেষণার স্বাধীনতা বিদ্যমান থাকে। মোকির ব্যাখ্যা করেন যে শিল্পবিপ্লব কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না; বরং এটি ছিল শতাব্দীব্যাপী জ্ঞান এবং চিন্তার ধারাবাহিক বিকাশের ফল। তাঁর জ্ঞান বিস্তারের ধারণা বোঝায় যে জ্ঞানের বিস্তারই উদ্ভাবনের অক্সিজেন, যেখানে শিক্ষা ও চিন্তাশীলতা বিকাশ লাভ করে, সেখানেই নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী সেবা জন্মায়।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
ফিলিপ আগিয়োঁ ও পিটার হাউইট তাদের গবেষণায় জোসেফ শুম্পিটারের ‘সৃজনশীল বিনাশ’ ধারণাকে আধুনিক তাত্ত্বিক কাঠামোতে রূপ দেন। তাঁরা দেখান যে উদ্ভাবন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা পুরোনো প্রযুক্তি ও উৎপাদন পদ্ধতিকে ধ্বংস করে নতুন, আরও কার্যকর ব্যবস্থার জন্ম দেয়। প্রতিযোগিতা এই প্রক্রিয়াকে গতিশীল রাখে, কারণ নতুন উদ্যোক্তারা বাজারে প্রবেশ করতে পারে এবং অদক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, রাইড-শেয়ারিং অ্যাপস উবার ও পাঠাও পুরোনো পরিবহন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে; অনলাইন নিউজপোর্টাল প্রথাগত সংবাদপত্রের পাঠক হ্রাস করেছে; ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার প্রসারও একটি গুরত্বপূর্ণ উদাহরণ, ব্যাংক চেক ও সরাসরি স্থানান্তরের পরিবর্তে এখন ক্রেতা ও বিক্রেতারা কোড বা অনলাইন পেমেন্ট ব্যবহার করছেন। এভাবে ব্যবসায়িক লেনদেন আরও দ্রুত, স্বচ্ছ এবং নিরাপদ হচ্ছে।
এই মডেল অনুযায়ী উদ্ভাবন-চালিত প্রবৃদ্ধি তখনই সম্ভব, যখন নীতিগত স্থিতিশীলতা, শিক্ষা, গবেষণা এবং মুক্ত প্রতিযোগিতা একসঙ্গে কাজ করে। উদ্ভাবন কেবল প্রযুক্তি উন্নয়নের বিষয় নয়; এটি প্রতিষ্ঠান, সমাজ এবং বাজারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। উদাহরণস্বরূপ, ফার্মাসিউটিক্যালশিল্পে নতুন ওষুধের উদ্ভাবন বা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নতুন সফটওয়্যার এবং সেবা উদ্ভাবন শুধু প্রযুক্তিগত নয়, বরং নীতি, প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার সমন্বয়ও প্রয়োজন।
এই ধারণাগুলোর সমন্বয়েই উদ্ভাবননির্ভর প্রবৃদ্ধি তত্ত্ব গঠিত হয়েছে, যা আধুনিক অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়নের অন্যতম দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। ২০২৫ সালে এই তিন অর্থনীতিবিদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁরা নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এটি জ্ঞান, উদ্ভাবন এবং নীতিগত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও সুস্পষ্ট করে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি: অর্জন ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ গত তিন দশকে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি দেখিয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্প, কৃষি উৎপাদন এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে দেশের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। তবে শিল্প খাতে প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতা, গবেষণায় সীমিত বিনিয়োগ এবং একাডেমিক শিক্ষা ও পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জ্ঞান শিল্প খাতে সঠিক প্রয়োগের অভাব দেশের উদ্ভাবনী সক্ষমতাকে সীমিত করছে। মানবসম্পদের মান, বিশেষ করে প্রযুক্তি ও ডিজিটাল দক্ষতার ঘাটতি, বাংলাদেশের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অবস্থানকে প্রভাবিত করছে। এ ছাড়া দেশের ছোট ও মাঝারি উদ্যোগগুলো উচ্চ প্রযুক্তি গ্রহণে পিছিয়ে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, টেক্সটাইল এবং ঔষধশিল্পের অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো স্বল্পমূল্য প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। এটি উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ক্ষুন্ন করছে। তা ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতে স্টার্টআপদের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক এবং নীতিগত সহায়তা নেই।
দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো কেবল পুঁজির ওপর নির্ভর না করে প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং গবেষণার মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে, সরকার উচ্চমানের প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর গুরত্ব দিয়েছে, উদ্যোক্তা ও স্টার্টআপদের সহায়তা করেছে, যার ফলে দেশটি বৈশ্বিক প্রযুক্তি হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সিঙ্গাপুর উদ্ভাবনী নীতি, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলেছে। এ ছাড়া চীনের উদাহরণ উল্লেখযোগ্য, যেখানে বিশাল গবেষণা ও উন্নয়ন খাত, ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ এবং স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম দেশের অর্থনীতিকে দ্রুত ও প্রযুক্তিনির্ভরভাবে প্রসারিত করেছে। জাপান দীর্ঘদিন ধরে প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং শিল্প খাতের গবেষণার মধ্যে সমন্বয় করে বিশ্বমানের উৎপাদন ও প্রযুক্তি পণ্য বাজারজাত করছে।
এ ছাড়া জার্মানি ও ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলোও শিল্প ও শিক্ষা সংযোগ, উচ্চমানের গবেষণা এবং উদ্ভাবনভিত্তিক নীতিমালা গ্রহণ করে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করেছে। এই আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য একটি প্রাসঙ্গিক শিক্ষা প্রদান করে। দেশের অর্থনীতি যদি শ্রমনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রযুক্তি, জ্ঞান এবং উদ্ভাবনভিত্তিক উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দেয়, তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় দেশের অবস্থান শক্তিশালী হবে এবং টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম ভিত্তি হলেও কাঠামোগত দুর্বলতা, খেলাপি ঋণ, প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতা এবং নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তবু ডিজিটাল ব্যাংকিং, ফিনটেকের সঙ্গে অংশীদারত্ব এবং তথ্যভিত্তিক ঋণ মূল্যায়ন ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে উদ্ভাবনমুখী করে তুলছে। এ ছাড়া গ্রীন ফাইন্যান্স ও টেকসই বিনিয়োগে নতুন প্রকল্পের অর্থায়ন উদ্ভাবননির্ভর অর্থনীতিকে সহায়তা করছে।
বাংলাদেশকে টেকসই উদ্ভাবননির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করতে হলে কয়েকটি কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। প্রথমত, গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা জরুরি; সরকার এবং বেসরকারি খাত যৌথভাবে উদ্ভাবনী তহবিল গঠন করলে নতুন প্রযুক্তি এবং স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম বিকশিত হবে। দ্বিতীয়ত, একাডেমিক শিক্ষা ও পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জ্ঞান শিল্প খাতে সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণার ফলাফল সরাসরি শিল্পক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারে এবং উদ্ভাবনমুখী উদ্যোগগুলোতে অবদান রাখতে পারে। তৃতীয়ত, মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে রোবোটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা দেশের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াবে। চতুর্থত, নীতিগত স্থিতিশীলতা এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। পূর্বানুমেয় নীতিমালা উদ্যোক্তাদের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে আস্থা জোগাবে এবং উদ্ভাবনমুখী উদ্যোগগুলোকে প্রসারিত করতে সহায়তা করবে।
উদ্ভাবনবান্ধব আর্থিক অবকাঠামো তৈরি করা অপরিহার্য, যেমন ডিজিটাল ব্যাংক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ঋণ মূল্যায়ন এবং উদ্ভাবনকেন্দ্রিক ঋণপণ্য প্রবর্তন। মোকির, আগিয়োঁ ও হাউইটের তত্ত্ব স্পষ্টভাবে দেখায় যে টেকসই উন্নয়নের জন্য জ্ঞান, উদ্ভাবন, প্রতিষ্ঠান এবং নীতির সমন্বয় অপরিহার্য। যদি বাংলাদেশ এই দিকগুলোতে মনোযোগ দেয়, তবে দেশ একবিংশ শতাব্দীতে উদ্ভাবননির্ভর, জ্ঞানভিত্তিক এবং টেকসই অর্থনীতির মডেল হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি অর্জন করতে সক্ষম হবে।
লেখক : মো. আবদুল কাদের, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে কর্মরত। ‘ব্যাংকিং অব টুমোরো, দ্য আর্ট অ্যান্ড সায়েন্স অব রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইন রিটেইল, সিএমএসএমই অ্যান্ড ডিজিটাল ব্যাংকিং’ বইয়ের লেখক