একজন শিক্ষকের দায়বদ্ধতা

শিক্ষকতাপ্রতীকী ছবি

চেহারায় তাঁর শত-সহস্র অজানার রেখা। তাঁর চোখের দীপ্তিময় ফুলকি জ্ঞানার্থীদের মনোজগতে এমন এক পুলকের সৃজন ঘটায়, যা তাঁর বাণী ছাড়া অন্য কিছুতে মনোনিবেশে বাধা সৃষ্টি করে। তিনি জানেন, সব সময় একরোখা আত্মনিবেশ অসম্ভব; সে জন্য তিনি তাঁর কথায় নিয়ে আসেন বৈচিত্র্য। গতানুগতিক ধারার একজন জ্ঞানবাহক শ্রেণিকক্ষে তাদের গুরুত্ব দেন, যারা প্রথম সারিতে বসে এবং যারা সর্বোচ্চ প্রতিক্রিয়া দেখায়। কিন্তু একজন প্রকৃত বিদ্যাদানকারীর লক্ষ্য থাকে তাঁর জ্ঞানালয়ের সব অংশগ্রহণকারী। বিশেষত যারা দুর্বল ও অমনোযোগী। ভালোরা, উৎসুকরা তো ভালো করবেই। তেলা মাথায় তেল দিয়ে কি জ্ঞান বৃদ্ধি হয়? এক শ জনের প্রতিক্রিয়ায় আপনি সাড়া দিয়ে যা অর্জন করবেন, তার থেকে বেশি অর্জন আপনার হবে যদি আপনি মাত্র একজন ছাত্রকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসতে পারেন।

বলছিলাম একজন সার্থক শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য নিয়ে। শিক্ষক ও তাঁর দায়িত্ব বা দায়বদ্ধতা একজন শিক্ষার্থীর জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ে, যখন একজন শিক্ষার্থী সদ্য স্বাধীনতা লাভ করে পারিবারিক জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ইতিবাচক ভূমিকা খুবই জরুরি। বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব ও সাংবিধানিক জটিলতা স্পষ্ট থাকায় শিক্ষকেরা তাঁদের শ্রেণি কার্যক্রম বিষয়ে জবাবদিহির আওতায় থাকেন না। এ ছাড়া শ্রেণিকক্ষে ক্লাসের মান, যথেষ্ট সংখ্যক ক্লাস নেওয়া, শ্রেণিকক্ষে নিরপেক্ষতা, শিক্ষার মূল সুর শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে পৌঁছানো ও শিক্ষা প্রদান পদ্ধতির কার্যকারিতা ইত্যাদি বিষয়েও তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। নেই প্রশাসন থেকেও কোনো জরুরি পদক্ষেপ। তাহলে একজন শিক্ষকের প্রকৃত ও নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্য নিশ্চায়নের উপায় কী?

শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা এবং এটি তখনই কার্যকর যখন একজন ব্যক্তি এটাকে হৃদয়ে ধারণ করেন, ব্যবসায়িক চুক্তি হিসেবে নেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীকে জ্ঞানার্জনের সঠিক পথে স্থির রাখতে যেমন পরীক্ষা, উপস্থাপন ইত্যাদি পদ্ধতি দ্বারা মূল্যায়নের মাধ্যম রয়েছে, ঠিক তেমনই শিক্ষকদের মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রণয়ন করা জরুরি, যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দ্বারা নির্ধারিত হবে। যেমন একটি নির্দিষ্ট বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর বা সেমিস্টারে প্রতিটি ক্লাস প্রদানকারী শিক্ষকদের মূল্যায়ন করবে। ধরা যাক, এ মানদণ্ড হচ্ছে ১০। ১০–এর মধ্যে কত রেটিং দেওয়া হবে, সেটি নির্ধারণ করবে প্রতিটি শিক্ষার্থী।

আবার শিক্ষকদের কোন বিষয় তাঁদের অনেক প্রশংসনীয় মনে হয়েছে বা কোনগুলো বিষয়ে একজন শিক্ষকের পাঠ্যক্রমে সংযোজন বা বিয়োজন করা উচিত, সেগুলো তুলে ধরার জন্য একটি ‘মতামত বাক্স’ রাখা যেতে পারে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দেওয়া রেটিং অনুযায়ী প্রতিবছর নির্দিষ্ট বিভাগের একজন বা একাধিক শিক্ষককে ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষক’ ঘোষিত করে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করা উচিত, যা তাদের শ্রেণি কার্যক্রম আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ করতে অনুপ্রাণিত করবে।

লেখক

সত্য প্রকাশে নিরপেক্ষতার জায়গায় একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক সব সময় অটল। যাবতীয় সব বিষয়ে নিরপেক্ষতা ও সমতার বিধান একজন প্রকৃত শিক্ষকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। শ্রেণিকক্ষে ও শ্রেণিকক্ষের বাইরেও একজন ছাত্রকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক সময় প্রশাসন থেকে দেওয়া একটি সুনির্দিষ্ট মার্কিং ফরম্যাট না মানায় বিভিন্ন শিক্ষকের অধীনে গ্রুপ বা সেমিনারভিত্তিক কাজে তাদের নিজস্ব স্বকীয় নম্বর পদ্ধতির জন্য একটি ব্যাচের গ্রেডিং সিস্টেমে বৈষম্য তৈরি হয়। সুতরাং একটি নির্দিষ্ট বিভাগের সব শিক্ষকের মধ্যে সমন্বয় করে একটি স্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ নম্বর ফরম্যাট মানা ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি বিভাগের সঙ্গে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের একটি মুখ্য ভূমিকা এখন সময়ের দাবি।

একজন ন্যায়বান শিক্ষক সমতার বিধানে অটল। ঠিক তেমনি তিনি তোষামোদ ও যথার্থ সম্মান প্রদর্শনের পার্থক্য বোঝেন এবং অতিরিক্ত কোনো কিছুই পছন্দ করবেন না। এ জন্য একজন শিক্ষক যদি তোষামোদপ্রিয় হয়ে থাকেন, তবে তাঁকে এ পেশায় না আসাই উচিত। কেননা, তিনি নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেলেন। শিক্ষক কিন্তু বক্তার সমার্থক শব্দ নয় যে তিনি শুধু বলেই যাবেন। তাঁর ক্লাস হবে সর্বোচ্চ অংশগ্রহণমূলক, যেখানে প্রত্যেকে তার চিন্তা, প্রশ্ন, বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ পাবে এবং এটা সেই শিক্ষক দ্বারাই উৎসাহিত হবে চরমভাবে। এ কার্যক্রমটি শিক্ষকের সম্মান রক্ষা করে বাস্তবায়িত হবে, যাতে কোনো শিক্ষক কোনো ছাত্র কর্তৃক অসম্মানিত না হন। ক্লাসে একজন শিক্ষক এটাও মাথায় রাখবেন যে তারও সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তিনিও ভুল করতেই পারেন এবং তিনি সেটি আন্তরিকভাবে স্বীকার করেন। এ জন্য, একজন প্রকৃত জ্ঞান বিলায়ক কোনো মত তাঁর শিক্ষার্থীর ওপর চাপিয়ে দেন না। একজন ফলপ্রসূ শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে সবার মনোযোগ রক্ষার্থে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন, যেমন তিনি একঘেয়েমি থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন হাসির বা শিক্ষামূলক ভিডিও প্রদর্শন, কোনো এক্সারসাইজ বা অন্য মাধ্যম ব্যবহার করতে পারেন। সর্বোপরি একজন প্রকৃত শিক্ষকই তাঁর ছাত্রকে শ্রেণিকক্ষের উপযোগী করে গড়ে তোলেন। তাঁকে মানবিকতা, ন্যায়, সততা এবং আরও অনেক কল্যাণকর গুণের সঙ্গে পরিচিত করান, যা তাঁর মধ্যে আগে থেকেই বিদ্যমান। কেননা, ছাত্ররা স্বভাবতই অনুকরণপ্রিয়। তার প্রতিটি পদক্ষেপের ইতিবাচকতা একজন প্রকৃত বিদ্যা অন্বেষণকারীকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্যই হলো এটি—জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান সৃষ্টিতে আগ্রহ তৈরি করা।

আবার নিজেদের মধ্যে রেষারেষি ও সম্প্রীতির অভাব থাকলে শিক্ষার্থীদের কীভাবে ভালোবাসা, দেশপ্রেম ও দায়িত্বের জ্ঞান প্রদান করা সম্ভব? সর্বোপরি, দল-মত এসবের সীমাবদ্ধতা দূর করে একটি সুনির্দিষ্ট বিভাগের সব শিক্ষকের মধ্যে সুসম্পর্ক ও সম্প্রীতি বজায় রেখে প্রতিটি ক্ষেত্রে সবার সঙ্গে সমন্বয় করে যাবতীয় শিক্ষা ও প্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে উচ্চশিক্ষার প্রকৃত বিধান নিশ্চিত হবে।

উপরন্তু শুধু অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে যে ব্যক্তি শিক্ষকতা করেন, তিনি কখনোই এই মহান পেশার মর্মার্থ বুঝবেন না এবং তিনি যে জাতি গঠনের মূল দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন, সেটা নিঃসন্দেহে একটি সমাজ, জাতি, দেশ তথা সমগ্র পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর। কেননা, তিনি কখনোই ছাত্রদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হবেন না কিংবা তাঁর সুরই কোনো দিন পুরোপুরি ছাত্রসমাজের, জ্ঞান খোঁজা জাতির হৃদয় স্পর্শ করবে না।

পরিশেষে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা এনে শিক্ষকদের শ্রেণি কার্যক্রমে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় দায়িত্বশীলতার পরিচয় না পেলে তাঁদের চাকরিচ্যুত করার বিধান রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যে ‘জাতির বিবেক’ হিসেবে পরিচিত, সে জন্য তাঁদের প্রতিনিয়ত গবেষণার পাশাপাশি দেশের প্রতিটি সংকটকালে দলীয় প্রভাবমুক্ত, নিরপেক্ষ ও লক্ষণীয় ভূমিকা পালন করার মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষক হবেন নীতিনৈতিকতা, মমত্ববোধ, দেশপ্রেম, ভালোবাসা, সততা এবং আরও ইতিবাচক গুণাবলির একটি জীবন্ত দৃষ্টান্ত, কেননা শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই অনুকরণপ্রিয়। এরই সঙ্গে প্রতিটি শিক্ষক নিয়োগ হবে স্বচ্ছ ও ন্যায্য উপায়ে, কোনো দল, স্বজনপ্রীতি বা দুর্নীতির ভিত্তিতে নয়, শুধু দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে। ঠিক তখনই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হবে সার্থক, শিক্ষা হবে কার্যকর এবং বাংলাদেশ হবে বিশ্বের মানচিত্রে এক ভিন্ন জাতি।

লেখক: মো. ইয়াসির আরাফাত, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়