নতুন শিক্ষামন্ত্রী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর কাছে শিক্ষকসমাজের প্রত্যাশা
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন–পরবর্তী দেশ নতুন শিক্ষামন্ত্রী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পেল। দুজনই বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল আমাদের চট্টগ্রামেরই সন্তান। তিনি চট্টগ্রামের প্রতিথযশা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মরহুম এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরীর সন্তান। আরেকজন অধ্যাপক রুমানা আলী। তিনি গাজীপুরের বারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য মরহুম রহমত আলীর কন্যা। সুতরাং বলাই যায় দুজনই নিজেদের সবটুকু সক্ষমতা দিয়ে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারবেন নিঃসন্দেহে। যে কারণে দেশের সর্বস্তরের শিক্ষকসমাজের প্রত্যাশা বেড়েছে। যদিও এরই মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষাক্রম ও মূল্যায়নে পরিবর্তনের ইঙ্গিত আনার ঘোষণা দিয়েছেন। শিক্ষকেরা মনে করেন, তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে এবার তাঁরা আশাবাদী হতে পারেন। দীর্ঘদিন শিক্ষকেরা নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে তাঁদের পেশা চালিয়ে নিচ্ছেন।
শিক্ষকদের নিয়ে আমরা অনেকেই সুন্দর সুন্দর কথা বলি। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে তাঁরা স্বল্প বেতন দিয়ে কীভাবে সংসার চালাচ্ছেন, তা কেউ ভাবছি না। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাঁদের চাকরি জাতীয়করণের জন্য আন্দোলন করেছেন দীর্ঘসময়, কিন্তু সুনিশ্চিত আশ্বাস পাননি। প্রাথমিকে সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতিতে ধীরগতি সিনিয়র শিক্ষকদের হতাশ করেছে।
সহকারী প্রাথমিক শিক্ষকেরা উচ্চতর স্কেলের জন্য আন্দোলন করলেও তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এসব বিষয়ে নতুন শিক্ষামন্ত্রী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীরা কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন বলেই মনে করি। মানুষ গড়ার নিপুণ কারিগর শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীকে মানুষ করার জন্য শিক্ষকের চেষ্টার অন্ত থাকে না।
আমাদের দেশে নানা সুবিধা বাড়লেও এখন পর্যন্ত শিক্ষকেরা সেভাবে কাঙ্ক্ষিত সম্মানী এবং অন্যান্য সুবিধাদি পান না। বর্তমানে সপ্তাহে এক দিন ছুটির পরিবর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই দিন করা হয়েছে এবং নতুন শিক্ষাক্রম ও শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাতে লাখ লাখ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করে যাচ্ছেন। এরপরও নানা সময় শিক্ষকেরা বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হন। সম্মুখীন হন নানা প্রতিকূলতার। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন সমাজের কিছু দুষ্ট লোক। তবে তাঁরা সংখ্যায় অতি নগণ্য।
শ্রদ্ধাবোধ কমে এলেও সমাজে শিক্ষকদের একটি সম্মানজনক স্থান রয়েছে। আগের দিনে মানুষ শিক্ষকদের যথোপযুক্ত সম্মান করতেন। নিজের সন্তানকে মানুষ করতে শিক্ষকের হাতে তাকে তুলে দিতেন। এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ শিক্ষকদের সম্মানের আসনে বসান, ছুটে যান তাঁদের যেকোনো সমস্যায়। সমাজে আলো ছড়াচ্ছেন শিক্ষকেরাই। পর্যাপ্ত সুবিধাদি না পেলেও তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। থেমে নেই তাঁদের কর্মতৎপরতা। দেশে প্রতিবছর পাবলিক পরীক্ষাগুলোর যে আশাজাগানিয়া ফলাফল, তার কারিগরও কিন্তু এই শিক্ষকসমাজ। তাঁদের প্রচেষ্টায়ই এই সফলতা। কিন্তু অপর্যাপ্ত বেতনে কীভাবে তাঁদের সংসার কাটছে, তা বলা মুশকিল। তাই শিক্ষকদের জন্য নতুন পে–স্কেল বা মহার্ঘভাতার ব্যবস্থা করার দাবি জানাচ্ছি।
দেশের সব স্তরে যাঁরা দায়িত্ব পালন করে চলেছেন, তাঁরা সবাই কোনো না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের ছাত্র। সে হিসেবে দেশের উন্নয়নের পেছনেও রয়েছে শিক্ষকদের অবদান।
শিক্ষকেরা বছর বছর দেশের জন্য তৈরি করছেন মেধাসম্পদ। যে সম্পদ দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সহায়ক। শিক্ষকদের প্রতি সবার উপযুক্ত শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। এই শ্রদ্ধাবোধের মাত্রা আমাদের সমাজ থেকে দিন দিন উবে যাচ্ছে। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোলেই দেখা যায় অনেক ছাত্র তার শিক্ষককে যথাযথ সম্মান দেয় না। এমনকি সালামটুকুও দিতে চায় না, যা আমাদের জন্য অবশ্যই চিন্তার বিষয়। হ্যাঁ, দেখা যায় বেশ কিছু শিক্ষক তাঁদের দায়িত্ব পালনে কম তৎপর থাকেন। এ ধরনের মন–মানসিকতা অবশ্যই পরিহার করা উচিত। এরপরও আমি বলব দেশের শিক্ষকদের বেশির ভাগই তাঁদের দায়িত্ব পালনে অটল থাকেন। অব্যাহত রাখেন শিক্ষার্থীদের শেখানোর প্রচেষ্টা।
শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কমিশন গঠনপূর্বক উপযুক্ত সম্মানীর ব্যবস্থা করা, নানা সুবিধাদি বৃদ্ধি ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করা দরকার। যথাযথ প্রশিক্ষণ, আবাসনব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো উচিত। শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মানীর যেন কোনো ঘাটতি না থাকে। কারণ, উপযুক্ত সম্মান ও সম্মানী শিক্ষকদের অধিকার। সুনিশ্চিত হোক তাঁদের অধিকার। শিক্ষকদের সেই অধিকার বাস্তবায়নে নতুন মন্ত্রীরা আশা করি উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবেন।
লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম