বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একদিন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

সকাল ১০টা‌, মাথা কাজ করতেছে না। যাইতে পারব তো? নাকি বাদ দিতে হবে আবার?

না না, এগুলা মাথায় আনা যাবে না। প্রস্তুতি নিলাম।

তাড়াতাড়ি চলে আয়, আমি আছি।

আচ্ছা, আসতেছি।

ঘর থেকে বের হইতেই দেখি অনেক মানুষ। লাঠি হাতে দাঁড়ায় আছে।

ওরা কারা? জানি না। তবে সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। যাওয়ার আগেই ধরা? না না, যাইতেই হবে। মাইশা অপেক্ষা করতেছে। কিন্তু উপায়? কোনো উপায় নেই? না! আছে!

রিকশা ধরলাম। গন্তব্য মাইশার বাসার আশপাশে। ও আশপাশেই থাকবে।

এই তো! চল আর্টিলারি।

ওকে।

বুঝতেছি না কী করব। শক্তি সব শেষ মনে হচ্ছে। রিকশা থেকে নামার পর দেখি আরও দুজন আসতেছে। শক্তি? এই তো ফিরে আসছে শক্তি!

শুনলাম আরও দুইজন আসতেছে। ভয়? জানালা দিয়ে পালাইছে। মনে মনে বাজতেছে আমরা দ্বিগুণ হব!

রাস্তায় মানুষ অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছিল। তাদের চোখে আমি ভয় দেখছি, কৌতূহল দেখছি, রাগ দেখছি, ক্ষোভ দেখছি, সন্দেহ দেখছি। সবাই আসার পর শুরু হইলো আরেক দ্বন্দ্ব, কোনো সিএনজিই যাবে না!

মামা যাবেন নিউমার্কেট?

না। পাগল নাকি?

আঙ্কেল, আঙ্কেল যাবেন? নিউমার্কেট?

না, যাইতাম না।

এবার? এখনই ফিরে যাব? না! ফিরে যাওয়ার জন্য তো আসি নাই। শেষে সিদ্ধান্ত হইলো লোকালে যাইতে হবে। সবাই লোকাল টেম্পুতে উঠলাম। নামলাম আগ্রাবাদ, বাদামতলী।

তারপর উঠলাম বাসে। কিন্তু বাসে জায়গাই ছিল না। দুইজন ভাইয়া সিট ছেড়ে আমাদের বসতে বললেন। পরে বুঝলাম ওনারাও একই পথের পথিক। আমরা কী বলব বুঝিই নাই, আবুলের দল। থ্যাংকস ভাইয়া, আমরা কৃতজ্ঞ।

বাস থেকে নামলাম, বাকি পথ হয় হেঁটে, নয় রিকশায় যেতে হবে। ঠিক করলাম রিকশা। এক ভাইয়া দৌড়ায়ে এলেন। বললেন, ‘তোমরা কই যাবা?’

চিনি না জানি না, প্রথমে ভয় হচ্ছিল।

নিউমার্কেট।

চলো, আমিও যাচ্ছি।

অতঃপর আমাদের নাম–ঠিকানা জানতে চাইলেন, জানালাম।

উনি কালকের আন্দোলনেও ছিলেন, মারামারি কালকেও হইছিল। ওনার কনুইয়ে ক্ষত ছিল, এখনো শুকাই নাই।

কিছুক্ষণ পর, আশপাশের মানুষ বলল, ওই দিকে রিকশা নিয়ে যাওয়া যাবে না, গেলেই মারবে!

মানুষ দৌড়ানো শুরু করছে, আমাদের ভাইয়া রিকশা থেকে নামাতে মানা করেন। রিকশা থামে না, চলতে থাকে।

আপনে রিকশা ওই যে ওই দিক দিয়ে নিয়ে যান। তোমারা এখন নামিও না।

একটা জায়গায় থামানো হয় রিকশা। রিকশা থেকে আমরা নামার পর অকালকুষ্মাণ্ডের মতো দাঁড়ায়ে আছি। ভাড়া দেওয়ার আগেই ভাইয়া ভাড়া দিয়ে দিলেন।

চলো, আমিও যাচ্ছি।

যাচ্ছিলাম, মেয়েদের একটা গ্রুপ ছিল, ভাইয়া আমাদের ওদের সঙ্গে যাইতে বলেন। এরপর ভাইয়া সেই যে গেল আর দেখলাম না।

ভিড়ে মিশে গেলাম। সবাই স্লোগান দিতে দিতে সামনে যাচ্ছিলাম। এত এত মানুষ আর এত এত স্লোগান! নিজেকে বুধা মনে হইতেছিল, স্লোগান জোরালো হলো, কেউ কেউ পানির বোতল দিচ্ছিল, মুগ্ধ? হ্যাঁ, ওরা সব্বাই মুগ্ধ!

আমাদের হাতে হাতে লটকন আর পেয়ারা দিল অনেক আঙ্কেল। বলল, যাও, খাইতে খাইতে যাও। আজকে তোমাগো লাইগা সব ফ্রি।

না! আমি না! আমরা! আমরা সবাই বুধা!

খেয়াল করলাম অনেক সামনে ধোঁয়া উড়ছে। কিসের? টিয়ার শেলের?

সামনে আগুন জ্বালছে, আতঙ্কের কিছু নেই!

মিছিল আবার সামনে যাচ্ছিল। স্লোগান হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল।

সবাই মুখে টুথপেস্ট মাখতেছে। মারছে? হুম কনফার্ম টিয়ার শেল মারছে। একজন এগিয়ে এসে টুথপেস্ট হাতে দিয়ে বলল, ধরেন, টুথপেস্ট মাখেন।

মুখে মাস্ক পরতে বলা হলো সবাইকে।

কিন্তু আমার কাছে মাস্ক নেই। মাস্ক পরব? নাক জ্বলছে? না, বুঝতেছি না। কোনো ধরনের অনুভূতি হচ্ছে না অথবা হইলেও বুঝতেছি না।

মুহুর্মুহু টিয়ার শেল মারতেছে। আমরা একবার দৌড়োচ্ছি তো দুইবার সামনে যাচ্ছি। একসময় দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখলাম, পাথর। আকাশ থেকে পাথর এসে আমাদের গায়ে পড়ছে। না, আকাশ থেকে না, ওরা মারছে, ওরাই টিয়ার শেল আর পাথর মারছে। একটু পর প্রচণ্ড জোরে আওয়াজ হলো। বুঝলাম, আওয়াজটা সাউন্ড গ্রেনেডের। কেউ আর দাঁড়িয়ে নেই। সবাই উল্টো দিকে দৌড়াচ্ছে। কতটা পথ দৌড়ালাম খেয়াল নেই। কিন্তু এবার ওদের হামলা টিয়ার শেল, পাথর আর সাউন্ড গ্রেনেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; ছোড়া হলো রাবার বুলেটও! এবারের দৌড়টা আগের চেয়েও ভয়ংকর ছিল। আর দৌড়াতে পারছিলাম না। মন বাঁচার আকুতি করলেও শরীর যেন মনেরই বিরুদ্ধে ছিল। পাশেই এক আপু অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন কোত্থেকে যেন মনেরই অজান্তে শরীরে বল এল। আপুকে ধরলাম। দৌড়াচ্ছি না, দাঁড়িয়েও আছি, তা নয়। আপুকে নিয়ে যেভাবে হোক, যেদিকে হোক যাচ্ছি। এরপর রাস্তায় দেখলাম সরু একটা জায়গা আছে। স্থানীয় কিছু মানুষ থাকে মনে হয়। ভাইয়ারা আমাদের ওইখানে যেতে বললেন। ওই দিকেই যাচ্ছিলাম। আপু ততক্ষণে একটু স্বস্তি ফিরে পেলেন। হঠাৎ দেখলাম দুজন আসতেছে। কাকে যেন তুলে আনতেছে। রক্ত! যাঁকে আনা হলো, উনি গুলিবিদ্ধ। গলা থেকে বেয়ে বেয়ে রক্ত পড়ছে, পেটে কিংবা বুকেও লেগেছে গুলি। স্থানীয় মানুষ কিছুটা এগিয়ে এসে একটা ঘরের দরজা খুলে দিল। লোকটাকে ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর দেখি, লোকটাকে ফার্স্ট এইড দেওয়া হয়েছে। এখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় উনি কলেমা পড়েছিলেন, হঠাৎ আঁতকে উঠলাম, মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখব বলে কখনো ভাবিনি। সবাইকে একসঙ্গে থাকার জন্য বলা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন আমাদের ওই সরু রাস্তা ধরে চলে যেতে বলেন।

ওই যে ওই রাস্তা দিয়ে উইঠা যাওগা।

মাইশা বলল, না, আমাদের বোনরা যায় নাই, ওরা একলা।

আমরা সবাই আবার একত্র হলাম। স্লোগান চলছে। আবার হামলা হলো, কিন্তু এবার পেছন থেকে। রামদা নিয়ে আসছে শুনলাম। সবাই আরেকটা গলির ভেতরে ঢুকে পড়লাম। এই গলিটায় একটা বড় বাসা ছিল। বাসার বিশাল গেটটা বন্ধ। ওপর থেকেই ভিডিও করছে অনেকে। আমাদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘গেটটা একটু খুলে দেন না।’ ওদের মধ্যে কারোরই সহযোগিতা করার মনোভাব দেখতে পেলাম না। আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম। ভবনের মানুষেরা বলল ওই রাস্তা দিয়ে না যেতে। ওই দিক থেকেও মানুষ আসছে। আমরা গলি থেকে বের হয়ে যেতে লাগলাম, পেছনে ফিরে দেখলাম ধোঁয়া! অনেক ধোঁয়া উড়ছে! ওরা আসছে।

তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে রোডে চলে এসেছি। আশপাশে সবুজ–শ্যামল প্রকৃতি। এমন একটা সময়ে প্রকৃতি উপভোগ করার কথা নয়, এমনকি এসব খেয়ালও করার কথা নয়। কিন্তু আমি খেয়াল করেছি, কেন করেছি জানি না। প্রকৃতি দেখতে দেখতে আমার মনে হলো, কেউ যেন কানের কাছে এসে বলছে, ‘একজন ডুবন্ত মানুষের চেতনা থাকে ভাসন্ত।’ এর স্পষ্ট মানে আমার জানা নেই। সবই অস্পষ্ট ও ধোঁয়াটে।

যাহোক, সবাই হাঁটছে, বোধ হয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে। কিছুদূর যেতেই দেখি কয়জন ভিড় করে দাঁড়িয়ে, সামনে থেকে স্পষ্ট করে কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি তাও মানুষের ভিড়ের ফাঁকে তাকালাম।

একটা লোক পড়ে আছে। চোখ আকাশের দিকে, খানিকটা উল্টো, চোখের পাতা নড়ছে না। মাথার পাশে অনেক রক্ত অনেক। বুঝলাম উনি আর নেই।

এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে আমি জ্ঞান হারানোর উপক্রম। কিন্তু পাশে মাইশা ছিল, ধন্যবাদ বন্ধু। সাহস পুরোপুরি হারায়নি।

কখন যে টাইগারপাসে চলে এসেছি খেয়াল নেই। দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু আশপাশে মানুষ নেই। কোথায় সবাই? সবাই ছত্রভঙ্গ।

কোথায় যাব, কীভাবে যাব, জানি না। চারদিকে রাস্তা। গুটিকয় লোক এখানে–ওখানে আগুন দিচ্ছে, কেউ রাস্তায় পড়ে থাকা মোটরসাইকেল, কেউ পাশের পুলিশ বক্স ভাঙচুর করছে।

যেদিকে তাকাই, সেদিকেই আগুন আর ভাঙচুর।

হঠাৎ এক আন্টি এলেন, হাতে কালো রঙের ব্যাগ আর একটা পানির বোতল। উনি এদিক–ওদিক তাকাচ্ছেন। আমি ভেবেছিলাম হয়তো কাউকে খুঁজছেন। জিজ্ঞেস করলাম, আন্টি, কাউকে খুঁজছেন?

আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, আল্লাহ তোমাদের হজরত আলীর মতো শক্তি দিক।

আর কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাওয়া গেল না।

আমরা টাইগারপাস চত্বরের নিচে দাঁড়িয়ে। কয়েকজন জোরে জোরে বলতে লাগল, ‘সবাই এখানে একসঙ্গে জড়ো হোন, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন না।’

আমরা চত্বরের নিচে বসে পড়লাম। মাইশা ওর আব্বুকে কল দিয়েছিল, বলল, যাতে আন্টিকে বোঝায়।

কল আসছে বারবার আম্মুর। রিসিভ করার সাথে সাথে শুনি আম্মু হাউমাউ করে কাঁদছে। আমি বললাম, ‘তুমি চিন্তা কোরো না, আমি চলে আসব।’ কেটে দিলাম।

হঠাৎ মাইশা উঠে অন্যদিকে গেল, ফোনে কথা বলা শেষে বলল, ‘চল, আমরা বাসায় যাচ্ছি।’

কিন্তু কীভাবে?

আরে আয়, রিকশা ধরতে হবে।

রিকশার খোঁজ করা হচ্ছে। গন্তব্য পূর্ব মাদারীপুর জামে মসজিদ। কিন্তু কেউ এ রকম ঠিকানার নাম শুনেছে বলে অন্তত তাদের হাবভাব দেখে মনে হয়নি।

আমরা রেললাইন পার করেছি, ওপাশে গিয়েই একটা বাংলা রিকশা ঠিক করা হলো।

যাবেন? হালিশহর, আই ব্লক?

হুম্‌।

যাইতে পারবেন তো? সমস্যা হবে না তো?

না না, সমস্যা হইবো না।

সংশয়–সংকোচ নিয়েই রিকশায় উঠে পড়লাম।

আম্মুকে কল দিলাম, বাসায় আসতেছি, রিকশায় উঠছি।

কিন্তু মাইশা বলছিল, আমরা পালিয়ে আসলাম না তো?

সেদিন আমার কাছে দেওয়ার মতো কোনো উত্তর ছিল না।

কিন্তু চেয়ে দেখো আমরা আজ স্বাধীন

খাঁচার ভেতর আর ডানা ঝাপটাই না,

নই আর পরাধীন।

টিস্যু দিয়ে চোখ মুখ মুছতে মুছতে খেয়াল করলাম, চোখ–নাক জ্বলছে। রিকশা থেকে নেমে পড়লাম।

*লেখক: সাইমা শাহাদাত, দ্বাদশ শ্রেণি, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]