অবক্ষয়ের জালে বন্দী তরুণ সমাজ
সম্প্রতি কয়েকজন স্কুলশিক্ষার্থীর জন্মদিন উদ্যাপনের একটা ঘটনার কথা জানতে পারি। যেখানে বন্ধুর (যার জন্মদিন পালন করা হয়) মাথায় ডিম ভেঙে জন্মদিন উদ্যাপন করতে দেখা যায় তাদের। ডিম ফাটিয়ে এমন উদ্যাপনের কারণে শ্রেণিকক্ষ নোংরা হতে দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের সুবাদেও শিক্ষার্থীদের কিছু অস্বাভাবিক আচরণ হরহামেশাই দেখা যায়। বিদায়লগ্নে বিদ্যালয়ের ফ্যান, টেবিল, বেঞ্চ নষ্ট করে দিয়ে, সহপাঠীদের সাদা গেঞ্জিতে অশালীন কথাবার্তা লিখে দিয়ে স্কুলের গণ্ডি পাড় হচ্ছে তারা।
শিক্ষকদের সঙ্গেও খারাপ আচরণ করতে দেখা যায় অনেককে। স্কুল ফাঁকি দিয়ে বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে তরুণ-তরুণীদের আড্ডার হিড়িক সহজেই নজরে আসে শহরের অলিগলি কিংবা পার্কগুলোর দিকে চোখ বুলালে। আবার অনেক ছেলেমেয়ে জড়িয়ে পড়ছে অবৈধ সম্পর্কে। মাদকের সঙ্গেও জড়িয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ।
স্মার্টফোন সহজলভ্য হওয়ায় ফেসবুক, টিকটিকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় অবাধ বিচরণ করতে দেখা যায় উঠতি বয়সী এসব তরুণ-তরুণীকে। ফেসবুকে একটার পর একটা রিল আর ভিডিও দেখাটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে অনেকের। ভালো-খারাপ বাছবিচার ছাড়াই সেগুলো উপভোগ করছেন এবং নিজেকেও ভাসিয়ে দিচ্ছেন অপসংস্কৃতির করাল গ্রাসে। তরুণদের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্থিরতা লক্ষণীয়। বাইক নিয়ে অবলীলায় রাস্তাঘাটে উচ্চ গতিতে চলাচল ও উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানো যেন নিত্য চিত্র হয়ে উঠেছে। বেপরোয়া গতিতে বাইক চালানোর কারণে সড়কে তরুণের তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়ার সংবাদ প্রায়ই পত্রিকায় শিরোনাম হয়।
মা-বাবার সঙ্গেও অসদাচরণ করে থাকেন অনেক তরুণ-তরুণী। সৃজনশীল ও সুন্দর বিনোদনের পরিবর্তে তাঁরা অশ্লীল ও রুচিহীন বিনোদনের দিকেই বেশি ঝুঁকছেন। কাউকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও পচানোটাও তাঁদের অনেকেই আনন্দ বিনোদন মনে করেন। দেশি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের চেয়ে ভিনদেশি কিংবা পশ্চিমা সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে গর্ব বোধ করে থাকেন কেউ কেউ। লাইক, শেয়ার, কমেন্ট পাওয়ার নেশায় বিভোর হয়ে অনেক তরুণ-তরুণীকে নিজের ব্যক্তিগত অনেক কিছুই ফেসবুকে শেয়ার করতে দেখা যায়। নিজের শোবার ঘরের ছবি, এমনকি অনেককে ছোট পোশাকের নিজের ছবি পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় পোস্ট করতে দেখা যায়। এতে নিরাপত্তার বিষয়টি যেমন বিঘ্নিত হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি।
কাউকে সহযোগিতা করার চেয়ে সাহায্যের নামে নিজেকে জাহির করার প্রবণতা অধিক মাত্রায় লক্ষণীয়। কোথাও দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটলে ঘটনাস্থলে হতাহত মানুষকে উদ্ধারের চেয়েও ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়াটাই যেন অনেকের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে। স্বার্থের হিসাবের মারপ্যাঁচে পড়ে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন মূল্যবোধ, বিবেকবোধ ও মানবিকতা। এত সব অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মধ্যেও কিছু জিনিস আমাদের আশাবাদী করে। তরুণদের হাতেই গড়ে উঠছে সেলুন পাঠাগার, রক্তদান ও রক্ত সংগ্রহের গ্রুপসহ স্বেচ্ছাসেবামূলক নানা সংগঠন। এ ছাড়া বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, গণিত অলিম্পিয়াড, গবেষণা, উদ্ভাবনসহ শিক্ষা, সংস্কৃতি নানান ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন আমাদের তরুণেরা।
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন থেকে নানান সংগ্রাম-আন্দোলনেও আমাদের তরুণ সমাজ ছিল সদা জাগ্রত ও নির্ভীক। আমাদের তরুণেরা সম্ভাবনাময়। তাঁদের সম্ভাবনাকে কাজ লাগতে হবে। তরুণদের মধ্য থেকে অবক্ষয়, মাদকাসক্তি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি, অপসংস্কৃতি দূরীকরণে মা-বাবা, শিক্ষক, পরিবারের সদস্য, পাড়াপ্রতিবেশী তথা সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অভিভাবকদের সন্তানের প্রতি আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।
অনলাইন-অফলাইন সবখানে অপসংস্কৃতির করাল গ্রাস রোধে এখনই নিতে হবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারের কুফল ও এগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার সম্পর্কে তরুণ সমাজকে অবহিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সভা, সেমিনারের ব্যবস্থা করতে হবে। তরুণদের অতিরিক্ত ভার্চ্যুয়াল মাধ্যম ব্যবহার থেকে বের করে এনে তাদের বাস্তবিক জগৎ ও দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যোগসূত্র দৃঢ়ীকরণে নিতে হবে পদক্ষেপ। অভিভাবকদের তাঁদের সন্তানকে ধর্মীয় ও নৈতিকতার শিক্ষাদানে যত্নশীল হতে হবে। পাড়া-মহল্লায় পাঠাগার, খেলার মাঠ, শরীরচর্চার ব্যবস্থা ইত্যাদি নিশ্চিত করে তরুণদের সুস্থ ও সুন্দর বিকাশ সাধন এখন সময়ের দাবি। মোদ্দাকথা, তরুণ সমাজকে অবক্ষয়ের এ ভয়ংকর ছোবল থেকে রক্ষা করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: মারুফ হোসেন, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়