‘নৈতিকতা আজ আইসিইউতে’
প্রাণহীন সবকিছুই বস্তু আর প্রাণময় সবকিছু জীব। জীবের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে মানুষ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নৈতিকতা-বিবর্জিত প্রাণময় একটি জীব কি মানুষ? নৈতিকতার একটি আদর্শ উদাহরণ হলো, ‘আপনার ও আমার অন্যের সঙ্গে সেভাবেই আচরণ করা উচিত, যেমনটি আমরা নিজেরা অন্যের থেকে আশা করি।’
সৃষ্টির শুরু থেকে পৃথিবীব্যাপী প্রাণময় ব্যক্তি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কিন্তু নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মানবীয় গুণসম্পন্ন প্রকৃত মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য এবং ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ঠিক তেমনি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নৈতিকতার চর্চা এবং প্রতিফলনও খুবই ক্ষীণ ও অপ্রতুল।
সমস্যা কোথায়? আমার মনে হয়, শুধু এবং একমাত্র সমস্যা হচ্ছে আমাদের ইচ্ছাশক্তি বা সদিচ্ছার অভাব। তা নয়তো সবাই আমরা একই পরিমণ্ডলে বিচরণ করেও সংখ্যায় নগণ্য নৈতিকতাসম্পন্ন মানবকাতরে অবস্থান করতে পারছি না কেন?
নৈতিকতা-বিবর্জিত প্রাণময় ব্যক্তি সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়ে ধনসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও আত্ম-অহংকারে বিজলির মতো যারা আজ জ্বলজ্বল করছি, সত্যিই কি আমরা আত্মতৃপ্ত? হৃদয়ে কি আমাদের সুনির্মল ও সুশীতল হাওয়া বয়ে যায়? দিনের আলো নিভে এলে চাঁদনি রাতে একলা বসে নিজের মনের কাছে কখনো কি জানতে চেয়েছি, আমি কি সঠিক কাজটি করছি? আমার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কি আমায় মনে রাখবে, নাকি কালের বিবর্তনে আমাকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে শুধু ছি ছি আর ধিক্কার দেবে?
যে পরিবার আমার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন, সেই পরিবার কি সমাজে ও তাদের ব্যক্তিজীবনে আমার পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করবে, নাকি লোকচক্ষু এড়িয়ে লজ্জায় লজ্জাবতীপাতার মতো চুপসে যাবে?
ভেবেছি কি একবারও? ভাবার সময় কোথায়? নৈতিক অবক্ষয়ে আমার ভাবনাশক্তি যে আজ আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
এভাবেই সময় চলে যাবে, মৃত্যুর করাল গ্রাসে নিপতিত হয়ে পাড়ি জমাতে হবে পরপারে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরগুলো না নিজে দিয়ে যেতে পারলাম, না ভাবার সময়টুকু পেলাম। জানানোর আর কোনো সুযোগও থাকল না আমার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন আমার পরিবারকে কতটা উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে বইঠা ও পালহীন পানশি নৌকায় রেখে গেলাম।
কথিত আছে, মা-বাবার কর্মের ফল সন্তানের জীবন-জীবিকাকে প্রভাবিত করে। যে সন্তানের জীবন-জীবিকার আলোকবর্তিকা আমি, সেই আমি কি তবে পারি না, শুধু আমার সন্তানের নিরাপদ ও কলঙ্কমুক্ত ভবিষ্যতের জন্য হলেও নিজেকে ভেঙেচুরে পরিবর্তন করে নৈতিকতার মুকুট পরে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বুকে শুকতারা হয়ে চির অম্লান হতে?
অবশ্যই পারি, আমাকে পারতেই হবে, আমি না মানুষ! বিবেকবান বলে আমি না সর্বশ্রেষ্ঠ জীব! না পারলে তবে আমার সেই শ্রেষ্ঠত্ব, যা সৃষ্টিকর্তার অপার উপহার, তাকে তো উপহাস করা ছাড়া অন্য কোনো কি গ্রহণযোগ্য জবাব দেওয়ার মতো মস্তিষ্কের নিউরনের ক্ষমতা আছে? যদি সেই দুঃসাহসিক ক্ষমতা থেকে থাকে, তবে ভিন্ন কথা, কিন্তু আমার সেই সাহসিকতার লেশমাত্র নেই। তাই আমাকে নতুন করে সব প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতি ও জরাজীর্ণতাকে উপেক্ষা করে নৈতিকতার পরশপাথরে মনটাকে ছুঁয়ে জীবনটাকে এক নতুন উদ্দীপনায় এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে, ‘মৃত্যুর কাছে পরাজিত হব, তবু নৈতিকতা বিসর্জন দিতে এ শির ন্যানো সেকেন্ডের জন্যও অবনত হয়ে নুয়ে পরবে না কখনো।’
আর কেবল তবেই শান্তির সুশীতল বাতাস হৃদয়কে প্রশান্তি দিতে পারে। মৃত্যু নামের চির বাস্তবতা সামনে এসে দাঁড়ালেও মনটা পুলকিত হয়ে উঠবে। আমার ক্ষুদ্র জীবন সবার অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
আসুন, আজ থেকেই প্রত্যেকে শপথ করি, নিজেকে বদলে ফেলে হয়ে উঠব নতুন এক ‘আমি’, আর তখনি বদলে যাবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র।
লেখক: মো. খালিদ হাসান, প্রভাষক, পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, গোকুল, বগুড়া