জসীমউদ্‌দীনের শিশুতোষ ছড়া-কবিতা: সাগর-পারের ঝিনুক হয়ে ভাসব সাগরময়

জসীমউদ্‌দীন

‘ডালিম কুমার’ গল্প কে শোনেনি? রূপকথার গল্পটির লেখক কবি জসীমউদ্‌দীন। জসীমউদ্‌দীন আমাদের বেশ কিছু শিশুতোষ লেখা উপহার দিয়েছেন। কিছু ছড়া ও কিশোর কবিতা তো এখনো মুখে মুখে বলে থাকি। আবার আমাদের অনেকে ব্যাপক জনপ্রিয় ছড়া-কবিতাটি যে জসীমউদ্‌দীনের, তা জানি না! আজ শিশুতোষ এমন কিছু ছড়া ও কবিতা নিয়ে আলোচনা করব।

জসীমউদ্‌দীনের ‘হাসু’ চমৎকার একটি শিশুতোষ কাব্য। শিশুমনকে নাড়া দেওয়ার মতো অনেক ছড়া আছে এ গ্রন্থে। ‘আমার বাড়ী’ ছড়াংশ: ‘আমার বাড়ী যাইও ভ্রমর বসতে দেব পিঁড়ে’। আবার ‘খোকার আকাঙ্ক্ষা’র মতো নীতিশিক্ষার ছড়া-কবিতাও রয়েছে। এ কবিতা থেকে দুই ছত্রÑ‘সবার সুখে হাসব আমি/ কাঁদবো সবার দুঃখে’। ‘রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও’—‘আসমানী’ কবিতার এ চরণটি সবার পড়া ও জানা।

‘এক পয়সার বাঁশী’ জসীমউদ্‌দীনের দ্বিতীয় শিশুতোষ কাব্যের বই। এখানে ‘এক পয়সার বাঁশী’, ‘হাসুমিয়ার চিঠি’, ‘মা ও খোকা’, ‘আসমানী’, ‘হাসুমিয়ার পাখীস্থান’, ‘গল্পবুড়ো’ শিরোনামীয় বেশ কিছু ছড়া/কবিতা রয়েছে। জসীমউদ্‌দীনের শিশুতোষ গল্প হচ্ছে ‘ডালিম কুমার’। এটিও আমাদের কাছে সম্যক পরিচিত। আর একটি মজার গল্পগ্রন্থ হচ্ছে, ‘বাঙালীর হাসির গল্প’। উল্লিখিত দুটি গল্পগ্রন্থে শিশুমনের অনেক খোরাকের জোগাড় হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের আঞ্চলিক ও লোকমুখে প্রচলিত কথা নিয়ে মজার মজার গল্প সাজিয়েছেন তিনি। ‘হাসু’ ও ‘এক পয়সার বাঁশী’ দুটি শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ। কাব্যগ্রন্থের বেশির ভাগ কবিতায় তোমাদের মতো করে লেখা। একটু না হয় পড়েই দেখো—

১. ‘এই খুকীটির সঙ্গে আমার আলাপ যদি হয়,/ সাগর-পারের ঝিনুক হয়ে ভাসবো সাগরময়;/ রঙীন পাখীর পালক হয়ে ঝরবো বালুর চরে,/ শঙ্খমোতির মালা হয়ে দুলব ঢেউ এর পরে।/ তবে আমি ছড়ার সুরে ছড়িয়ে যাব বায়,/ তবে আমি মালা হয়ে জড়াব তার গায়’। (আলাপ, হাসু)

২. ‘এই খুকীটির সঙ্গে তোমার আলাপ যদি থাকে,/ বলো যেন আসমানীদের বারেক কাছে ডাকে’।(খোসমানী)

৩. ‘খুকুমণি! লক্ষ্মমণি! তোমায় আমি চাঁদ বলিব,/ সন্ধ্যা মেঘের টুকরো ছিঁড়ে তোমার দুটো পায় দলিব’। (কবি ও চাষার মেয়ে, এক পয়সার বাঁশী)

৪. ‘এত হাসি কোথায় পেলে/ কথার খলখলানি/ কে দিয়েছে মুখটি ভরে/ কোন বা গাঙের কলকলানি।/ কে দিয়েছে রঙিন ঠোঁটে/ কলমী ফুলের গুলগুলানি।/ কে দিয়েছে চলন বলন/ কোন সে লতার দোল দুলানী’। (এত হাসি কোথায় পেলে)

ফুটবল খেলোয়াড় ইমদাদ হকের কথা কিন্তু ছোট্টবেলাতেই শুনেছি। কবি জসীমউদ্‌দীনের ‘ফুটবল খেলোয়াড়’ কবিতা থেকে—‘আমাদের মেসে ইমদাদ হক ফুটবল খেলোয়াড়,/ হাতে পায়ে মুখে শত আঘাতের ক্ষতে খ্যাতি লেখা তার।/ সন্ধ্যাবেলায় দেখিবে তাহারে পটি বাঁধি পায়ে হাতে,/ মালিশ মাখিছে প্রতি গিঁটে গিঁটে কাত হয়ে বিছানাতে।/ মেসের চাকর হয় লবেজান সেঁক দিতে ভাঙা হাড়ে,/ সারা রাত শুধু ছটফট করে কেঁদে কেঁদে ডাক ছাড়ে।/ ...বাম পায়ে বল ড্রিবলিং করে ডান পায়ে মারে ঠেলা,/ ভাঙা কয়খানা হাতে পায়ে তার বজ্র করিছে খেলা।/ চালাও চালাও আরো আগে যাও বাতাসের আগে ধাও,/ মারো জোরে মারো—গোলের ভিতরে বলেরে ছুড়িয়া দাও।’

বিন্নি ও শালি ধানের নাম আমরা শুনেছি, তাই না? নবান্নের সময় এসবের কদর ছিল আগেকার সময়। এসবের খবর কিন্তু কবি জসীমউদ্‌দীনের কবিতা থেকেই বেশি শুনেছি আমরা। আরও শুনেছি মৌরীখেতে লুটোপুটি খেলা—

১. ‘আমার বাড়ি যাইও ভোমর,/ বসতে দেব পিঁড়ে,/ জলপান যে করতে দেব/ শালি ধানের চিঁড়ে।/ শালি ধানের চিঁড়ে দেব,/ বিন্নি ধানের খই,/ বাড়ির গাছের কবরী কলা/ গামছাবাঁধা দই’। (আমার বাড়ি)

২. ‘চির বিরিঞ্চির গাছে রে ভাই লাল টুকটুক টিয়া,/ বসে আছে মৌরী-ফুলের ছাতি মাথায় দিয়া’। (আবোল তাবোল, এক পয়সার বাঁশী)

কবি জসীমউদ্‌দীনের মানবিক সত্তাও ফুটে উঠেছে শিশুতোষ ছড়া ও কবিতায়। আবার ব্যথাতুর হয়েছে এতিম শিশুর শোকে—

১. ‘সবার সুখে হাসব আমি/ কাঁদব সবার দুখে,/ নিজের খাবার বিলিয়ে দেব/ অনাহারীর মুখে’। (সবার সুখে)

২. ‘কোথায় আমার রাজার কুমার, শুয়ে মায়ের কোলে/ তোমার কি ঘুম ভাঙবে না এই শিশুর চোখের জলে’। (পূর্ণিমা)।

এতিম শিশুর জন্য ব্যথাতুর কবি। হৃদয়ে শোক এনে দাগ কেটে দেয় কবিতাটি।

৩. ‘রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! বারেক ফিরে চাও,/ বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?/ ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ/ কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা;/ সেথায় আছে ছোট্ট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া,/ সেই ঘরেতে একলা বসে ডাকছে আমার মা/ সেথায় যাব, ও ভাই এবার আমায় ছাড় না!’ (রাখাল ছেলে)

৫. ‘আসমানীদের দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,/ রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।/ বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,/ একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।/ একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,/ তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।/...পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়, নিতুই যে জ্বর তার,/ বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর’। (আসমানী)।

এই কবিতায় গ্রামের গরিব ও হতভাগ্যের কথা তুলে ধরেছেন কবি। এ কবিতাটিও আমরা প্রায়ই পড়ে থাকি এখনো।

তোমাদের মতোই ছোট্ট মেয়ে হাসু। এই হাসুকে নিয়েই কবি জসীমউদ্‌দীন লিখলেন ‘হাসু’ কবিতা। ‘হাসু একটি ছোট্ট মেয়ে এদের মতো, তাদের মতো,/ হেথায় হোথায় ছড়িয়ে আছে খোকা-খুকু যেমনি শত।/ নয় তো সে চাঁদের চাঁদকুমারী তারার মালা গলায় পরে/ চালায় না সে চাঁদের তরী সারাটা রাত গগন ভরে.../ তবু তারে ভালোই লাগে চাঁদের দেশের চাঁদের মেয়ে/ শঙ্খমালা, কঙ্খমালা, রঙ্গমালা সবার চেয়ে।’

কবি জসীমউদ্‌দীন: জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯০৩, মৃত্যু ১৪ মার্চ ১৯৭৬।

লেখক: কবি