রাষ্ট্রের মেরামত চলছে, অনুগ্রহপূর্বক অপেক্ষা করুন
ডেটলাইন: ৩৬ জুলাই। বেলা ৩টা ৫। স্থান: বনানী কাকলী সড়ক।
‘ঈদের দিনের চেয়ে বেশি আনন্দ হচ্ছে’, ভদ্রমহিলা স্বামীকে নিয়ে হাঁটছেন। সঙ্গে ছোট দুই ছেলেমেয়ে। লাখো জনতার সঙ্গে বুকে পিঠে লাল-সবুজ বেঁধে চলছি আমরা বাপ-বেটা। যাব শহীদ মিনার, শাহবাগ। পাশেই একজন ‘আমরা স্বাধীন’ বলে উচ্চ কণ্ঠ। সঙ্গে তিন বছরের মেয়ে। প্রতিটি মুখে অপার আনন্দ, তৃপ্তি। দেড় দশকের রুদ্ধ কণ্ঠ খুলেছে, ‘আরেকবার স্বাধীন হলাম’। আনন্দ-স্লোগানে মুখর রাজপথ। জগদ্দল পাথরচাপা সময় পেরিয়ে এসেছি। সমালোচনা দূরে থাক, কোনো আলোচনাই করা যেত না মুক্তচিন্তা নিয়ে। রেহমান সোবহানের কথায়, ‘আমার সমালোচক। আমার বন্ধু—ছিল “আমার সমালোচক বড় ষড়যন্ত্রকারী।”’ মুক্ত আলোচনা-সমালোচনা করলেই বদলি, ওএসডি। কখনো চাকরি খতম। জেল, রিমান্ড, ডিএসএ। এ যেন মধ্যযুগের কথা, বললেই বেত্রাঘাত।
মেডিকেল কলেজে এক বৈজ্ঞানিক অধিবেশনে ভুল তথ্য উপস্থাপন হচ্ছিল। এ নিয়ে কথা বললাম দুবার। যার অধিবেশন তিনি একজন চিকিৎসক নেতা। পাশে বসে থাকা সিনিয়র বন্ধু হাত চেপে ধরলেন। ‘নেতার অধিবেশন। এত ভুল ধরার দরকার কি? চেহারা দেখেন, আপনার ওপর খেপছে! চুপ করে বসে থাকেন।’ মঞ্চের দিকে তাকিয়ে দেখি, কথা তো সত্যি, ভদ্রলোক আমার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছেন। মস্তিষ্কের ভেতর তীব্র ওলট-পালট, একাডেমিক আলোচনাও করতে পারব না। তাহলে পরের প্রজন্ম শিখবে কীভাবে? এ তো একজন শিক্ষক হিসেবে আমার মৌলিক কাজ, অধিকার। পরবর্তী ১৩-১৪ বছর মেনে চলেছি, অন্ধই দৃষ্টিবান। সর্বত্রই একই অবস্থা। কুলুপ আঁটা ছিল বেশির ভাগ গণমাধ্যম।
কয়েক দিন আগে, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে একটা লেখা পাঠিয়েছিলাম পত্রিকায়। সম্পাদক ছাপিয়েছেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ সম্পর্কে দুটি বাক্য ছেঁটে দিয়ে। আলাপে অসহায়ত্ব, ‘ভাই বোঝেনই তো। পত্রিকা চালাতে গেলে কত কিছু করতে হয়!’ বেনজীরের নজিরবিহীন দস্যুতার সাফাই গেয়েছেন মন্ত্রী, ‘অনেকবার মিশনে গিয়ে টাকা রোজগার করেছেন তিনি।’ বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান গোপালগঞ্জের সংখ্যালঘুদের জমি খেয়েছেন সন্ত্রাসী শক্তি দিয়ে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সমগ্র বাংলাদেশে তাঁর জমি-ধন। নাহ, তাতে কোনো সমস্যা নেই। যেমন কোনো সমস্যা হয়নি ‘আমার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক’ হওয়ায়। কেউ আগে জানতেন না, যেন গতকাল আলাদিনের প্রদীপ তাঁকে দিয়ে গেছে এই অর্থ। অথচ বহুবার এই পিয়নের অবৈধ অর্থ রোজগারের গোয়েন্দা তথ্য পিয়নের মালিকের হাতে দেওয়া হয়েছিল।
শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে, স্তাবক-অযোগ্যদের করা হয়েছে উপাচার্য, অধ্যক্ষ। মেডিকেল কলেজের এক অধ্যক্ষকে জানি, যিনি ক্লাস নিতেন Slide Share থেকে ডাউনলোড করে এবং সেগুলো রিডিং পড়ে লেকচার দিতেন। বোঝানোর কারবার ছিল না। এ ভদ্রলোক ২ বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও পেয়েছিলেন অবসরের পর। শিক্ষা আর গবেষণার বদলে এসব প্রতিষ্ঠানে দলচর্চা হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান, বিশ্ব মানচিত্রে তলানিতে নামিয়ে এনেছেন ‘ছা-ছপ’ খেয়ে। সেই সঙ্গে আগাছার মতো গড়ে উঠেছে মেডিকেল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়। মার্কেটের ওপরতলায় মেডিকেল কলেজ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রূপান্তরিত হয়েছিল জমিদারের লেঠেল বাহিনীতে। ‘ধরে আন। মার।’ ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা মেরে দেওয়ার শাস্তি, মন্ত্রিত্ব নেই। দুর্নীতি দমন কমিশন হয়েছিল ‘দুর্গতি দেও কমিশন’। দেশের প্রতিটা ক্ষেত্র এমনটা হওয়া শুধু গত দেড় দশকের কথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। লালমাটিয়ার পাড়ার ছেলেটার অল্প দিনে বনানী ডিওএইচএসে বাড়ি কিনে দেশের ব্যবসা নিয়ন্ত্রক হওয়ার গল্প তো সবার জানা। একই সময়ের আরেক গল্প। ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটা বিভাগে অদক্ষ-অপেশাদার একজনকে বিভাগীয় প্রধান করা হবে। বদলি হবেন দক্ষ-মেধাবী অধ্যাপক। এটা জানাতে তৎকালীন চিকিৎসক নেতার উক্তি, ‘সরকার তাঁকে উপযুক্ত মনে করেছে। আপনারা কি সরকারের চেয়ে ভালো বোঝেন!’ লাও ঠেলা! এই কাঠামোতেই চলছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র—থোড় বড়ি খাড়া/খাড়া বড়ি থোড়। ঘরে ঘরে মর্মর মূর্তি আর সাংবিধানিকভাবে সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখার বিধান দেখে দেশের বাইরে লেখাপড়া করা এক তরুণ জানতে চেয়েছিলেন, ‘উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আমাদের পার্থক্য কোথায়?’ এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। কাউকে জিজ্ঞেসও করিনি। কুলুপ দেওয়া মুখ কি আর কথা বলতে পারে!
যে কাঠামো বছরের পর বছর নষ্ট মানুষের আশ্রয়স্থল। পাঁচ দশক ধরে দেশের শ্বাসমূল চুষে খাওয়ার স্থান। সাধারণ মানুষের টাকা বিদেশে পাচারের বাহন, সেটাতে রাষ্ট্র আর চলতে পারে না। তারুণ্য বলেছে, আমরা এ পথে আর চলব না। চলতে দেব না। নির্বাচন হবে। রাজনীতিবিদেরাই দেশ শাসন করবেন।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সেটাই। কিন্তু রাষ্ট্রের এ কাঠামোতে নয়। নতুন কাঠামো হতে হবে। যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জমিদারের লেঠেল হবে না। পুলিশ দেখলে বিপদগ্রস্ত মানুষ ভাববেন, আর ভয় নেই। বন্ধু এসেছে। ব্যাংকের আমানত নিয়ে ঋণখেলাপি হতে পারবেন না কেউ। পাচার হওয়ার সুযোগ থাকবে না সাধারণ মানুষের পাঠানো মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হবে না মাস্তানি, হবে শিক্ষাগবেষণা। তৈরি হবে ভবিষ্যৎ দেশ পরিচালনার মানবসম্পদ। বিদেশে নয়, সবাই চিকিৎসা নেবেন দেশে। বিদেশ থেকে দেশে ফিরবেন মেধাবী সন্তানেরা। কারণ, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’।
বিগত দিনগুলোতে (কেবল গত ১৫ বছর নয়) দেখেছি, বিবাদমান রাষ্ট্রকাঠামো এটা করতে দেয়নি, দেবেও না। এই কাঠামোর ভেতর দিয়ে নির্বাচিত-অনির্বাচিত যেই-ই এসেছে, তারাই হয়ে উঠেছে এক নায়ক। অচল-অকার্যকর এই কাঠামোকে মেরামত করতে হবে, যেখানে বসে আগামীর রাজনৈতিক নেতারা দেশ গড়ার কাজ করবেন। স্বৈরতন্ত্র চাইলেও জেঁকে বসতে পারবে না। জবাবদিহি থাকবে জনগণের কাছে। তা কেবল পাঁচ বছর পরপর ভোটের জবাবদিহি নয়।
তারুণ্যের এ গণজাগরণ বলছে, রাষ্ট্রকে মেরামত করতে হবে। তারা নিজেরা নেমে পড়েছে এই কাজে।
আগে মেরামত। তারপর নির্বাচন। অপার সম্ভাবনাময় এই দেশটাকে আপনারা রাজনীতিবিদেরাই তৈরি করবেন। তবে এখন ‘রাষ্ট্রের মেরামত চলছে। অনুগ্রহ করে একটু অপেক্ষা করুন।’
*লেখক: অধ্যাপক ডা. সাকিল আহম্মদ, [email protected]
*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]