নগরে ডে কেয়ার সেন্টার কেন জরুরি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চলমান গতিশীল অর্থনীতির কারণে ২০৪১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে বলে আমরা আশা করি এবং একই সঙ্গে সেই স্বপ্নও দেখি। আয়ের এই গতিশীলতাকে ধরে রাখতে হলে নারী-পুরুষ উভয়কে সমানতালে ঘরে-বাইরে কাজ করতে হবে এবং দেশের অর্থনীতিতে সমান অবদান রাখতে হবে। 

অন্যদিকে, বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়া নারীর সংখ্যা ৩৮ শতাংশ। কিন্তু ২০২২ সালের জুন মাসের এক পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত নারীর সংখ্যা ২ কোটি, যেখানে নারী-পুরুষ মিলে কর্মক্ষম শ্রমশক্তি মোট ১১ কোটি।

শিক্ষা শেষে একজন নারী প্রথমে চাকরি শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে ঠিকভাবে চালিয়ে নিতে পারেন না। কর্মক্ষেত্রে সন্তানের লালনপালনের ব্যবস্থা ও ডে কেয়ার সেন্টার না থাকার কারণে একসময় চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন অনেক কর্মজীবী নারী। আর যাঁরা এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে চাকরি শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারেন, তাঁরা সৌভাগ্যবান। বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন নারী ডিউটি চলাকালে তাঁর সন্তান নিরাপদে থাকবে কি না, সে চিন্তা করে চাকরি করার সিদ্ধান্তকে একটি জটিল প্রক্রিয়া বলে মনে করেন।

শিশুবিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, যেসব শিশু একা একা বড় হয়, তাদের মূল্যবোধ, শেয়ারিংসহ অন্যান্য জীবনবোধ যেসব শিশু একটা যৌথ পারিবারিক আবহে বড় হয়, তাদের চেয়ে তুলনামূলক কৃত্রিম ও জটিল। 

সময়ের প্রয়োজনে আমাদের দেশের পারিবারিক কাঠামোয় এসেছে পরিবর্তন, আর এই পরিবর্তনকে আমাদের ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে হবে, এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে আমাদের শিশুকে বড় করতে হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার ৪২ দশমিক ৬৮, যা ২০১৬ সালের ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশের চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি (সূত্র: প্রথম আলো, ১৪.০৭.২০২৩)। এভাবে শহর ও গ্রামে নারীদের কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার হার দিন দিন বাড়ছে। 

আমাদের দেশের নগরগুলো মূলত ডেভেলপ করেছে সাধারণ মানুষের খেয়ালখুশিমতো এবং যত্রতত্র, পর্যাপ্ত নগর-পরিষেবা ছাড়াই। একটি শিশুর জন্ম থেকে শৈশব–কৈশোরে বেড়ে ওঠার জন্য যে মানবিক পরিবেশ প্রয়োজন, তা আমাদের দেশের শহরগুলোয় প্রায় অনুপস্থিত, এমনকি গ্রামে সেই পরিবেশ হারিয়ে যাচ্ছে। 

এ ক্ষেত্রে শিশুদের নিরাপত্তা ও বিকাশে ভূমিকা রাখতে সহায়তা করতে পারে ডে কেয়ার সেন্টার। এখানে অনেক শিশু একসঙ্গে বড় হয়, যা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই শহরে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন ১১৯টি এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন রয়েছে ২০টি শিশুদিবাযত্নকেন্দ্র, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। 

নগর এলাকায় প্রাইভেট ডে কেয়ারের নামে আমরা যা দেখতে পাই, তা হলো শুধু একটা ভবনের মধ্যে কিছু ইনডোরে খেলাধুলার সরঞ্জাম, যা খানিকটা কারাগারের শামিল বলে মনে হয়। 

শিশুবান্ধব একটি নগরের লক্ষ্য হলো শিশুর নিরাপত্তা ও বিকাশ এবং নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিশ্চিত করা।

আমরা যদি ঢাকার পেরিফেরিয়াল এলাকা এবং অন্যান্য কিছু জেলা, যেমন নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ জেলার দিকে লক্ষ করি, তবে দেখতে পাই মাদ্রাসাশিক্ষাটা দিন দিন ভীষণভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কারণ, একজন অভিভাবক মাদ্রাসায় পাঠিয়ে সন্তানকে সারা দিনের জন্য নিরাপদ বোধ করেন এবং ওই এলাকার নিম্নবিত্ত নারীরা গার্মেন্টস বা অন্য কোনো শিল্পকারখানায় অনায়াসে কাজ করতে পারেন। 

যাহোক, ড্যাপ অনুযায়ী রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার ঢাকা মহানগরাধীন এলাকায় ৮৬২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। জানামতে, এ বিদ্যালয়গুলোয় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয়ে থাকে। বেশির ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছোট হলেও একটি খেলার মাঠ রয়েছে। এখানে ডে কেয়ার এবং প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম একই সঙ্গে চালানো সম্ভব।

জাপান এবং বিশ্বের অনেক দেশেই এ রকম সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ডে কেয়ার টাইপ স্কুলিং চালু রয়েছে। যে কারণে অভিভাবকদের কর্মস্থলে গিয়ে অযথা সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না; নারী-পুরুষ সমানভাবে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারেন। এই স্কুলগুলো তাঁদের দেশের শিশুদের নিয়ম-নৈতিকতার চর্চার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। 

পৃথিবীর সব দেশের বাজেটে শিশুশিক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ থাকে। আমাদের যেহেতু স্পেস ও অর্থনৈতিক সংকট রয়েছে, তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই অবকাঠামোকে কাজে লাগিয়ে ডে কেয়ারভিত্তিক স্কুলিং চালু করা যেতে পারে এবং এটাই বর্তমান সময়ের দাবি। 

ছোটবেলা থেকেই শিশুরা খেলাধুলা ও শেয়ারিংয়ের মধ্যে বেড়ে উঠলে বর্তমানে বাড়তে থাকা এক শিশুভিত্তিক একক পরিবারের সন্তানেরা যে আত্মিক দ্বন্দ্বে ভোগে, তা অনেকটা কমে আসবে। এ ধরনের ডে কেয়ারভিত্তিক স্কুলিং চালু করলে শহর ও গ্রামে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরা নিশ্চিন্তে ঘরের বাইরে কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। 

ফারজানা ববি: নগর-পরিকল্পনাবিদ ও গল্পকার