মহেশপুর: যোগাযোগ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে কৃষি চাষাবাদ ও রেলপথের গুরুত্ব

কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ১৬১ বছরের পুরোনো জগতি রেলস্টেশনছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে প্রথম রেল চালু হয় ১৮৬২ সালে দর্শনা থেকে জগতি পর্যন্ত। ব্রিটিশ আমলে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার দত্তনগর কৃষি খামারে উৎপাদিত সবজি কলকাতার বাজারে সরবরাহে দর্শনা-গেদে রেলপথ ব্যবহার করা হতো। ফলে বলা যায়, প্রথম থেকেই রেল কৃষি অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। স্বল্প খরচ ও নিরাপদ যাতায়াতে রেলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থায় সড়কপথের যতটা উন্নয়ন হয়েছে, রেলে উন্নয়ন তার থেকে অনেক কম। তবে রেল যোগাযোগের গুরুত্ব অনুধাবন করে যমুনার ওপর রেলসেতু নির্মাণ, পদ্মা সেতুর সঙ্গে রেল সংযোগ, ঢাকা-জয়দেবপুর ও ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবল লাইন এবং কক্সবাজারকে রেল যোগাযোগের সঙ্গে যুক্ত করাসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার। এতে যাত্রী পরিবহনের সঙ্গে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী পরিবহনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে রেলপথ। কৃষিপণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত সার, বীজ ও কীটনাশক সরবরাহে এবং উৎপাদিত পণ্য ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে রেলপথ গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে। সুতরাং আমরা বলতে পারি, কৃষি অর্থনীতির উন্নয়ন ও যোগাযোগে রেলপথের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

রাজধানী শহর ঢাকার সঙ্গে যশোর ও খুলনা অঞ্চলের রেল ও সড়কপথের দূরত্ব ঘোচাতে পদ্মা সেতু প্রধান ভূমিকা রাখছে। আবার এই পথ ব্যবহার করে চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে দ্রুত যাতায়াত করা সম্ভব। সরকার ঢাকা-যশোর রেললাইন নির্মাণ করছে, যা ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে চালু হবে। একসময় ট্রেনে যশোর থেকে ঢাকা শহরে যেতে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা সময় লাগত। এখন রুট পরিবর্তন হওয়ায় দুই ঘণ্টা সময় কম লাগছে। তবে যশোর থেকে নির্মিত রেলপথ চালু হলে তিন ঘণ্টারও কম সময়ে ঢাকা পৌঁছানো সম্ভব হবে। এতে যশোরের বাণিজ্যিক শহরখ্যাত নওয়াপাড়া, বাগেরহাটের মোংলা ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের দূরত্বও অনেক কমে যাবে। ফলে দেশ–বিদেশে ব্যবসা–বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে।

যশোর থেকে সড়কপথে মহেশপুরের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়কের চুরামনকাঠির পশ্চিম পাশ দিয়ে চৌগাছা হয়ে মহেশপুরে একটি আঞ্চলিক মহাসড়ক, যেটি দত্তনগর হয়ে পাশের উপজেলা জীবননগর শহরে মিশেছে। এখন যশোর থেকে ঢাকা ও উত্তরবঙ্গ রুটের রেললাইনের চুরামনকাঠি অংশ থেকে চৌগাছা, মহেশপুর ও জীবননগর উপজেলা শহরের মধ্য দিয়ে দর্শনা পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ করতে হবে। এতে কয়েক লাখ মানুষ সরাসরি রেল–সুবিধা পাবে।

মহেশপুরের আবহাওয়া ধান, ফুল, ফল ও সবজি উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে কৃষকদের দেশের বিভিন্ন স্থানে এগুলো পাঠাতে সড়কপথের ওপর নির্ভর করতে হয়। এতে খরচের পরিমাণ বেড়ে যায়। রেলপথ থাকলে স্বল্প খরচে সারা দেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী দ্রুততর সময়ে পাঠানো সম্ভব। মহেশপুরে অনেকগুলো ছোট–বড় বিল–বাঁওড় রয়েছে। মৎস্য ও কৃষি গবেষণার মাধ্যমে এখানে উৎপাদিত নতুন জাতের ফুল, ফল, ফসল ও মাছের রেণু পোনা দেশ–বিদেশে পাঠানো সম্ভব। দেশের ফুল ও রেণু পোনার অর্ধেকের বেশি চাহিদা মেটায় যশোর। এখন উৎপাদনের নতুন স্থান হিসেবে মহেশপুরকে বিবেচনায় আনতে হবে। কারণ, কৃষি ও মৎস্য চাষে মহেশপুর একটি সম্ভাবনাময় জায়গার নাম।

একসময় উৎপাদিত পণ্য ঢাকা শহরে পৌঁছাতে ব্যবসায়ীরা নানা সমস্যায় পড়তেন। বিশেষ করে ফেরিঘাটে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো। এতে অনেক পচনশীল পণ্য নষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু সেতু চালু হওয়ায় এ সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়েছে। এখন যশোর থেকে মহেশপুর হয়ে দর্শনা পর্যন্ত রেল যোগাযোগ শুরু হলে কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্য আরও কম খরচে ঢাকা শহরসহ সারা দেশে পৌঁছাতে পারবে। এতে ভোক্তারা টাটকা সবজি, ফল ও মাছ কম খরচে হাতে পাবেন। অন্যদিকে কৃষক বা ব্যবসায়ীদের পরিবহন খরচও কমে যাবে।

এখন আধুনিক চাষাবাদ বিস্তারের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদনে সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা প্রয়োজন। কৃষিপণ্য, গবাদিপশু পালন, মাছ চাষ ও সরবরাহে এখানে গবেষণা প্রতিষ্ঠান, প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ও হিমাগার নির্মাণ করতে হবে। বেকার তরুণদের উদ্যোক্তা তৈরিতে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করতে হবে। গ্রামে গ্রামে অ্যাগ্রো ফার্ম তৈরি করে এখানে স্বল্প মূল্যে বীজ, সার ও বিনা সুদে ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের মাধ্যমে মাস্টার্স ও ডিপ্লোমা ডিগ্রি প্রদান করে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। কারণ, শিক্ষা মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করে। বর্তমানে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি হাতেকলমে শিক্ষা নিয়ে অনেক যুবক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তা ও কৃষকদের পণ্য সম্পর্কে জানাতে ওয়েবসাইট খুলে দিতে হবে। নিয়মিত আবহাওয়ার তথ্য ও কৃষি বুলেটিন সরবরাহ করে কৃষি উৎপাদন ও বিপণন বৃদ্ধি করা যায়।

সরকার ঢাকা ও বড় শহরের জনসংখ্যা কমাতে উদ্যোগ নিচ্ছে। ফলে উপজেলা শহর ও গ্রামে কাজের ব্যবস্থা করতে পারলে মানুষের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা কমে যাবে। গ্রামের নারীদের হাঁস–মুরগি পালন ও আঙিনাতে সবজি উৎপাদনে সহযোগিতা করতে হবে। এ ছাড়া পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে কাজ করতে হবে, যা আর্থসামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করবে।

যশোর পর্যন্ত নির্মিত রেলপথ পার্শ্ববর্তী জেলা খুলনা, নড়াইল, বাগেরহাট, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও সাতক্ষীরার মানুষের কৃষির উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। পণ্য সরবরাহে আলাদা মালবাহী গাড়ির ব্যবস্থা রাখতে হবে। ফসলের মাঠ ও বাজার থেকে পণ্য রেলস্টেশন পর্যন্ত আনতে সরকারিভাবে বিশেষ পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। এই উদ্যোগগুলো আধুনিক কৃষি চাষাবাদ বিস্তার ও অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। অন্যদিকে রেল যোগাযোগ এই কাজগুলো আরও সহজ করে দেবে।

লেখক: মো. শাহিন রেজা, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।