লালুর শীতের বাজার অভিযান

প্রথম আলো ফাইল ছবি

শীত নামলেই মানিকদির বাজারে অন্য রকম উৎসব লাগে। চারদিকে শুধু সবজি আর সবজি। লাল শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, গাজর, বেগুন, পালংশাক, লালশাক, পুঁইশাক সব মিলিয়ে একটা সবুজ-লাল স্বপ্নের ছবি।

কিন্তু এবারের শীতে ঘটল এক ভয়ানক অদ্ভুত ঘটনা। সবজির দাম এমন বাড়ল যে মানুষ হকচকিয়ে গেল!

এক কেজি বেগুনের দাম শুনে এক চাচা চোখ কপালে তুলে বললেন, এটা কি বেগুন, না সোনার ডিম!

ছোট্ট লালু পাশে দাঁড়িয়ে ভাবল, সবজি এত দামি হলে মানুষ খাবে কী?

সে বাড়িতে গিয়ে বাবাকে বলল, আব্বা, আমি আজ বাজারে গিয়ে সবজি কিনে আনব।

বাবা মুচকি হেসে বললেন, যদি একটা আলু কিনে আনতে পারো, তাহলে বুঝব তুমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছ।

এই কথা শুনে লালু বুক ফুলিয়ে মানিকদির বাজারের দিকে রওনা দিল।

বাজারে ঢুকেই সে যেন অবাকের নদীতে ডুবে গেল! একটা বড় বেগুন উচ্চ গলায় বলছে, আমার দাম দুই শ টাকা, কারণ আমি শীতের রাজপুত্র! পাশে দাঁড়ানো এক ফুলকপি গম্ভীর হয়ে বলল, আমি কুয়াশার মধ্যে বড় হয়েছি, আমাকে কম দামে নিলে আমার মন খারাপ হবে!

লালু তো হতভম্ব! সে এগিয়ে গেল আলুর কাছে। আলু ভাই, আপনার দাম কত? আলু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার তো আর সস্তা দিন নেই, আলু… এখন আমি রুপার মতো, আমারও ওদের মতো সমান দাম!

লালু বলল, তোমরা সবাই এত দামি কেন হয়ে গেলে?

আলু কাঁপা গলায় বলল, কারণ মানুষ মাটিকে ভালোবাসা ভুলে গেছে, আমাদের আর নিজের হাতে ফলায় না।

ঠিক তখন লালুর চোখ গেল এক পাশে সাজানো শাকের ঢিবির দিকে—পালংশাক, লালশাক আর পুঁইশাক।

তারা তিনজন একসঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, লালু ভাই, আমাদেরও এখন দাম আকাশছোঁয়া! পালংশাক—মানুষ বলে আমরা নাকি ওষুধ, তাই আমাদের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। লালশাক, আমাদের রং যেমন লাল, দামও তেমন লাল হয়ে গেছে। আর পুঁইশাক আমরা নরম আর সুস্বাদু, তাই আমরাও আর সস্তা রইলাম না।

লালু অবাক হয়ে বলল, কিন্তু তোমরা তো গরিবের সবচেয়ে আপন বন্ধু ছিলে!

পালংশাক দুঃখ করে বলল, হ্যাঁ, কিন্তু মানুষ এখন বাড়ির আঙিনায় আর আমাদের লাগায় না। সবাই শুধু বাজারের দিকেই তাকিয়ে থাকে। এই কথা শুনে লালুর বুকটা কেমন যেন হালকা ভারী হয়ে এল। সে বুঝে গেল, সবজির আসল মূল্য কেবল টাকায় না, এর ভেতরে আছে মাটির গন্ধ, কৃষকের ঘাম আর প্রকৃতির ভালোবাসা।

লালু কোনো সবজি কিনল না। খালি হাতেই বাসায় ফিরে এল। মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সবজি আনলে না? লালু মৃদু হেসে বলল, মা, বাজারে না কিনে আমরা নিজেরাই সবজি লাগাব। তবেই সবজির দাম কমবে। পরদিন থেকেই মানিকদির মানুষেরা লালুর কথা শুনে কাজ শুরু করল।

বাড়ির পাশে ছোট ছোট সবজি বাগান বানাল। পালংশাক, লালশাক, পুঁইশাক লাগাল। কৃষকদের সম্মান দিল। একে অপরের সঙ্গে সবজি ভাগাভাগি করল।

আর আশ্চর্যভাবে কিছুদিন পরেই বাজারে সবজির দাম কমতে শুরু করল। সবজিগুলো যেন খুশি হয়ে বলল, আমরা দাম বাড়াইনি…

মানুষই আমাদের ভুলে গিয়েছিল। মাটিকে ভালোবাসলে, আমরাও তাদের ভালোবাসি।

লালু তখন মাটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, আজ আমি আলু কিনিনি ঠিকই, কিন্তু আমি আশার একটা বীজ বুনে দিয়েছি! মানিকদির বাতাসে তখন শুধু একটাই শব্দ ভেসে বেড়ায়... মাটি মানেই জীবন।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]