বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরোর মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি: বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা

ক্রেডিট ব্যুরো একটি দেশের আর্থিক ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, স্থিতিশীলতা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার গুরত্বপূর্ণ মাধ্যম, যা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ইতিহাস ও ঋণসংক্রান্ত লেনদেনের তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করে। এসব তথ্য ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অনুমোদিত ব্যবহারকারীদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হয়, যাতে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে যথাযথ ঝুঁকি নিরূপণ করতে পারে।

ক্রেডিট ব্যুরো বিভিন্ন আর্থিক ও লেনদেনসংক্রান্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গ্রাহকের ক্রেডিট স্কোর এবং বিস্তারিত ক্রেডিট রিপোর্ট প্রস্তত করে। ঋণপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এই রিপোর্ট ব্যবহার করে ঋণগ্রহীতার পরিশোধের সক্ষমতা ও সম্ভাব্য ঝুঁকি মূল্যায়ন করে ঋণ অনুমোদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

বর্তমান তথ্যনির্ভর অর্থনীতিতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বেগবান করার ক্ষেত্রে আধুনিক ক্রেডিট স্কোরিং–ব্যবস্থা একটি মৌলিক ও কৌশলগত ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ ব্যবস্থা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রাহকের ঋণ পরিশোধসংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঝুঁকি নিরূপণে সাহায্য করে, যা ঋণপ্রক্রিয়াকে অধিকতর কার্যকর, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলে। ক্রেডিট স্কোর এমন একটি সংখ্যা, যা ব্যক্তির আর্থিক আচরণ, বিশেষ করে ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের ধারাবাহিকতা মূল্যায়ন করে নির্ধারণ করে থাকে। সাধারণত এটি ৩০০ থেকে ১০০০–এর মধ্যে থাকে। যত বেশি স্কোর, তত ভালো আর্থিক অবস্থাকে বোঝায়।

এই স্কোর নির্ধারণে যেসব বিষয় গুরুত্ব পায়, তা হলো গ্রাহকের নিয়মিত কিস্তি পরিশোধের ইতিহাস, ঋণের পরিমাণ, কত দিন ধরে ঋণ ব্যবহার করছেন, কত ধরনের ঋণ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা আছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে নতুন ঋণের খোঁজ করছেন কি না। যাঁদের স্কোর ভালো, তাঁরা সহজে, দ্রুত ও কম সুদে ঋণ পেতে পারেন। শুধু ঋণ নয়, চাকরি, বাসাভাড়া বা বিমার খরচ নির্ধারণেও এই স্কোর কাজে লাগে।

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে শক্তিশালী আইনি কাঠামো, সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যাংকিংয়ের বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীকে আর্থিক খাতে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, একাধিক উন্নয়নশীল দেশে বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরোর কার্যক্রম চালুর পর ঋণের প্রাপ্যতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ঋণখেলাপির হার হ্রাস পেয়েছে। যখন ঋণদাতারা পূর্ণাঙ্গ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে সক্ষম হন, তখন কম ঝুঁকিপূর্ণ গ্রাহকেরা তুলনামূলকভাবে কম সুদে ঋণ গ্রহণের সুযোগ পান, যা সামগ্রিক আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে ত্বরান্বিত করে।

বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরো উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছে। পেরুতে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যখন মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণগ্রহীতাদের ইতিবাচক ঋণ পরিশোধের তথ্য পারস্পরিকভাবে শেয়ার করতে শুরু করে, তখন অনেক গ্রাহক বৃহৎ ব্যাংকিং সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ঋণ গ্রহণে সক্ষম হন। এর ফলে তথ্য ভাগাভাগির মাধ্যমে ঋণের সুযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি অনুন্নত ও প্রান্তিক অঞ্চলে ঋণ বিতরণ ব্যাপক হারে বিস্তৃত হয়। যথাযথ তত্ত্বাবধান ও তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে একটি সমৃদ্ধ ঋণ তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা গেলে কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র, মাঝারি উদ্যোক্তাসহ (সিএমএসএমই) সব শ্রেণির ঋণগ্রহীতাই এর সুফল ভোগ করতে পারবেন।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য হলেও তা এখনো মূলত সরকারি উদ্যোগের ওপর নির্ভরশীল। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) গঠনের মাধ্যমে দেশের প্রথাগত ঋণঝুঁকি ব্যবস্থাপনার যাত্রা শুরু হয়। ২০১১ সালে এর অনলাইন সেবা চালু করা হয়, যা ব্যাংকিং খাতে ঋণসংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান আরও গতিশীল করে। তবে এত দিন দেশে কার্যকর কোনো বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরো ছিল না, যার ফলে তথ্যের পরিধি ছিল সীমিত এবং অনেক মানুষ আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে থেকে গেছেন।

ডিজিটাল বাংলাদেশের অভিযাত্রায় যখন নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হচ্ছে, তখন একটি শক্তিশালী ও টেকসই ক্রেডিট স্কোরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমবারের মতো বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরো গঠনের জন্য নির্দেশিকা জারি করে, যা নিঃসন্দেহে একটি দূরদর্শী ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত।

নতুন এই নীতিমালার অধীনে নির্দিষ্ট পরিমাণ পুঁজি ও নির্ধারিত মানদণ্ড পূরণ সাপেক্ষে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে ক্রেডিট ব্যুরো হিসেবে নিবন্ধিত হতে পারবে। এ ধরনের ব্যুরোগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবি তথ্যভান্ডার, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবহারকারীর ঋণগ্রহণযোগ্যতা মূল্যায়ন করবে।

বাংলাদেশে যদি আধুনিক ক্রেডিট ব্যুরো চালু করা হয়, তাহলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্যাংকের বাইরে থাকা প্রায় চার কোটির বেশি মানুষকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনা সম্ভব হবে। এতে শুধু তথ্যের ঘাটতি দূর হবে না, বরং ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর ব্যবস্থা তৈরি হবে, যা নিরাপদ এবং নির্ভুলভাবে ঋণ দেওয়া নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।

বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরো গঠনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা নির্ধারণ করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সর্বনিম্ন ১০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন, সীমিত দায়বদ্ধতাসম্পন্ন কোম্পানি কাঠামো এবং পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে ব্যাংকিং ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অভিজ্ঞতা থাকা। পাশাপাশি, ক্রেডিট স্কোরিং মডেল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণে গ্রাহকের সম্মতি ও গোপনীয়তা রক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি নিরাপত্তা নির্দেশিকা অনুসরণ এবং সংশ্লিষ্ট সব তথ্য বাংলাদেশেই সংরক্ষণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ উদ্যোগ একটি নিয়ন্ত্রিত, নিরাপদ এবং গ্রাহক-স্বার্থবান্ধব ক্রেডিট পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থিক খাতকে আরও শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলবে।

বর্তমানে দেশের আর্থিক খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। এ পরিবর্তনের সময়েও অসংখ্য যোগ্য ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রথাগত ঋণব্যবস্থার আওতায় আসতে পারছেন না। কারণ, তাঁদের পূর্ববর্তী ঋণ গ্রহণের অভিজ্ঞতা নেই কিংবা তাঁরা আনুষ্ঠানিক আর্থিকব্যবস্থার বাইরে অবস্থান করছেন।

আধুনিক ক্রেডিট ব্যুরোগুলো এই চিত্র পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এসব ব্যুরো প্রচলিত ঋণ মূল্যায়ন পদ্ধতির বাইরে গিয়ে অপ্রচলিত ও বিকল্প তথ্য বিশ্লেষণ করতে সক্ষম, যেমন গ্রাহকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কার্যক্রম, ইউটিলিটি বিল পরিশোধের ধরন, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে লেনদেনের ইতিহাস, মোবাইল এবং অন্যান্য ডিজিটাল আচরণগত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারা একটি পূর্ণাঙ্গ ও বাস্তবসম্মত ক্রেডিট প্রোফাইল তৈরি করতে পারে। এ ধরনের উদ্ভাবনী তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে নির্মিত ক্রেডিট প্রোফাইল দায়িত্বশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ঋণপ্রবাহের পথ দেখাতে পারে এবং দেশের সামগ্রিক আর্থিক কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা ও গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে একটি স্বচ্ছ, সমন্বিত ও বিস্তৃত ক্রেডিট ইনফরমেশন সিস্টেম আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি।

বাংলাদেশে বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরোর কার্যক্রম শুরু হলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, নতুন উদ্যোক্তা এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর যাঁরা এত দিন প্রথাগত ব্যাংকিং–সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলেন, তাঁরা সহজে ঋণসুবিধা পেতে সক্ষম হবেন।

বাংলাদেশে বর্তমানে ৯ কোটির বেশি মোবাইল ওয়ালেট ব্যবহারকারী রয়েছেন এবং প্রতিবছর তিন ট্রিলিয়নের অধিক অনলাইন লেনদেন সম্পন্ন হচ্ছে। পাশাপাশি ডিজিটাল ঋণদাতা প্ল্যাটফর্মগুলোর ক্রমবর্ধমান বিস্তারের ফলে বিপুল পরিমাণ বিকল্প তথ্য (প্রচলিত নয় এমন তথ্য) তৈরি হচ্ছে। এই তথ্যের মধ্যে রয়েছে মোবাইল রিচার্জ, বিদ্যুৎ-পানির বিল পরিশোধ, ই-কমার্স লেনদেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কার্যকলাপ। এসব বিকল্প তথ্যকে দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করলে যাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, এমন ব্যক্তিদেরও আর্থিক লেনদেন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। এর ফলে ক্রেডিট ব্যুরোগুলো এমন ব্যক্তিদের জন্যও পূর্ণাঙ্গ আর্থিক প্রোফাইল তৈরি করতে পারবে।

গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ২৮.৩ শতাংশ মানুষের ব্যাংক হিসাব আছে। অর্থাৎ প্রতি চারজনের মধ্যে প্রায় তিনজন এখনো ব্যাংকিং–সেবার বাইরে রয়েছেন। যদিও অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, এই বিকল্প তথ্যগুলো ব্যবহার করে এখন নতুন ধরনের আর্থিক প্রোফাইল তৈরি করা সম্ভব। দায়িত্বশীল ও প্রযুক্তিগতভাবে সুরক্ষিত উপায়ে এই ডেটা ব্যবহারের মাধ্যমে এমন ব্যক্তিদেরও ঋণসক্ষমতা মূল্যায়ন করা যাবে, যাঁরা এত দিন ব্যাংকিং কাঠামোর বাইরে ছিলেন। এতে করে গ্রাহকের আর্থিক লেনদেন সম্পর্কে আরও গভীর তথ্য পাওয়া যাবে এবং তাঁদের জন্য আরও বিস্তৃত  ঋণসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

বিশ্বজুড়ে ক্রেডিট ব্যুরো ও স্কোরিং–ব্যবস্থার বাস্তবায়নে বৈচিত্র্য দেখা যায়, প্রতিটি দেশের আর্থিক কাঠামো, তথ্যপ্রবাহ ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অনুসারে এর কার্যকারিতা ভিন্ন হয়ে থাকে। বিশ্বের অনেক দেশেই ক্রেডিট স্কোরিং সিস্টেম ব্যবহার করে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো হচ্ছে।

ভারতে বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরো চালুর জন্য একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা আছে, যেখানে একাধিক দেশি-বিদেশি ব্যুরো কাজ করছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি পাবলিক ক্রেডিট রেজিস্ট্রি (পিসিআর) তৈরি করেছে, যেখানে ব্যাংক, এনবিএফসি (নন-ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল কোম্পানি) এবং কর তথ্যসহ আর্থিক ও অনার্থিক সব তথ্য একত্র করা যায়। এই উদ্যোগের ফলে স্বচ্ছতা বাড়ছে এবং ঋণের ঝুঁকি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা যাচ্ছে। এ ছাড়া আধার নম্বর সংযুক্ত প্রোফাইল, ইউনিফায়েড পেমেন্টস ইন্টারফেস (ইউপিআই) লেনদেন, বিদ্যুৎ বিল ও মোবাইল ব্যবহারের মতো বিকল্প তথ্য ব্যবহার করে এমন ব্যক্তিদেরও ঋণের আওতায় আনা যাচ্ছে, যাঁদের আগে কখনো ঋণের ইতিহাস ছিল না বা যাঁরা ব্যাংকের বাইরে ছিলেন।

ওপেন ব্যাংকিং–ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী ক্রেডিট স্কোরিং সিস্টেমকে গুরুত্বপূর্ণভাবে সহায়তা করে। কারণ, এটি গ্রাহকের আর্থিক তথ্য নিরাপদভাবে ব্যবহার করার সুযোগ দেয়। এর ফলে আরও সঠিক ও তথ্যভিত্তিক ক্রেডিট মূল্যায়ন সম্ভব হয়। ওপেন ব্যাংকিং হলো এমন একটি এপিআই–ভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা, যা ব্যাংক ও অনুমোদিত তৃতীয় পক্ষের মধ্যে নিরাপদ ও সম্মতিতে তথ্য আদান-প্রদান নিশ্চিত করে। মালয়েশিয়ায় এই ওপেন ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু আছে। তারা বিকল্প তথ্য ব্যবহার করে যারা ব্যাংকিং সেবার বাইরে ছিল, এমন ব্যবসাগুলোকে ঋণ দিতে সাহায্য করছে। সিঙ্গাপুরেও ফিনটেক ও ক্রেডিট ব্যুরোর সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে ওপেন ব্যাংকিং নীতিমালার আওতায় লেনদেনের তথ্য একত্র করে নির্ভুল ঋণ মূল্যায়ন করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে ফেয়ার ক্রেডিট রিপোর্টিং অ্যাক্ট (এফসিআরএ) অনুযায়ী, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে রিয়েল টাইম ক্রেডিট স্কোরিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং বিকল্প তথ্যের ব্যবহার ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাজ্যেও ওপেন ব্যাংকিং কাঠামোর মাধ্যমে রিয়েল টাইম স্কোরিংয়ের পাশাপাশি গ্রাহক স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রিত তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে কঠোর ডেটা প্রাইভেসি আইন থাকায় গ্রাহকের সম্মতি ছাড়া তথ্য শেয়ার করা যায় না। পশ্চিমা বিশ্বে ক্রেডিট স্কোর শুধু ঋণ অনুমোদনের জন্য নয়, বরং বাড়িভাড়া, গাড়ি ক্রয়, এমনকি চাকরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশে একটি দৃঢ় আইনগত ও প্রযুক্তিভিত্তিক কাঠামো গড়ে তোলা এখন সময়োপযোগী ও অগ্রাধিকারযোগ্য বিষয়, যাতে প্রতিযোগিতামূলক, স্বচ্ছ ও কার্যকর ঋণসেবা প্রদানের পথ সুগম হয়।

মোবাইল ব্যাংকিং, ডিজিটাল পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, মাইক্রোফাইন্যান্স, সিআইবি এবং জাতীয় পরিচয়পত্রভিত্তিক তথ্যভান্ডার একীভূত করে ঋণগ্রহীতাদের একটি সম্পূর্ণ, নির্ভরযোগ্য ও যাচাইযোগ্য প্রোফাইল তৈরি করা সম্ভব, যা ঝুঁকি মূল্যায়ন ও ঋণ সিদ্ধান্ত গ্রহণকে আরও কার্যকর ও তথ্যভিত্তিক করবে। পাশাপাশি গ্রাহকের গোপনীয়তা রক্ষা, তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি দৃঢ় ও কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য। এসব উপাদান আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও ডিজিটাল ঋণ ব্যবস্থাপনার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

যদি এসব উদ্যোগ একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা যায় এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে বাংলাদেশও যদি কার্যকর নীতিমালা ও আধুনিক প্রযুক্তি বাস্তবায়নে সফল হয়, তাহলে বাংলাদেশ খুব সহজেই ২০৩০ সালের মধ্যে একটি আধুনিক, টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারবে। এতে নারী, তরুণ উদ্যোক্তা এবং আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হবে, যা দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।

  • লেখক: মো. আবদুল কাদের, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে কর্মরত। ‘ব্যাংকিং অব টুমোরো, দ্য আর্ট অ্যান্ড সায়েন্স অব রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইন রিটেইল, সিএমএসএমই অ্যান্ড ডিজিটাল ব্যাংকিং’ বইয়ের লেখক