বার্বি: নারীবাদ, পুরুষতন্ত্র আর অস্তিত্বের সংকটের গল্প
সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া বক্স অফিস হিট ‘বার্বি’, যেখানে মিলে গেছে অস্তিত্বের সংকট, পিতৃতন্ত্র, লিঙ্গবৈষম্য আর জনপ্রিয় সংস্কৃতির সেই আইকনিক ‘ডল’ বার্বি। নারীর জীবনের জটিলতাগুলোকে অ্যাবসারডিস্ট দর্শনের থিমে এভাবে আর কোনো বাণিজ্যিক সিনেমায় অনুসন্ধান করা হয়েছে বলে মনে হয় না। ‘হ্যাটস অব টু দ্য ডিরেক্টর গ্রেটা গারউইগ’, যিনি বার্বিকে হলিউডের কম্পার্টমেন্টালাইজড কারখানায় প্রস্তুত আর দশটা বাণিজ্যিক পণ্যের খেতাব আর বার্বি ডলেরই কেবল একটি বিজ্ঞাপন হওয়ার সম্ভাবনা থেকে বের করে আনতে পেরেছেন; অত্যন্ত সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জটিলতর অবধারণগত অসংগতিগুলোকে বিনোদনধর্মী হালকা হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে এনেছেন; দর্শককে উপহার দিয়েছেন অনবদ্য এক শৈল্পিক সৃষ্টি!
‘ফ্রান্সেস হা’ সিনেমায় গ্রেটা গারউইগকে এক অনন্য মাপের অভিনেত্রী হিসেবে দেখা গিয়েছিল। পরিচালক নোয়াহ বুমবাখের সঙ্গে সেই সিনেমার চিত্রনাট্যও তিনি লিখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে গ্রেটা পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘লেডি বার্ড’–এর মাধ্যমে, যেখানে উঠতি বয়সী এক মার্কিন কিশোরীর বেড়ে ওঠার গল্প রয়েছে। ২০১৯ সালে তিনি তৈরি করেন ‘লিটল উইমেন’, যা অস্কারের জন্য মনোনীত হয়। দুটি সিনেমাতেই তিনি সমসাময়িক সমাজ, পরিবার, পরিবেশের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক, নারীর জগৎ-জীবনবোধ, চাওয়া-পাওয়া, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বিষয় উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন। সর্বশেষ এই ‘বার্বি’তেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
১৯৫৯ সালে আমেরিকায় নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গের সময়ে শিশুদের খেলনা হিসেবে প্লাস্টিক ডল বার্বি বাজারে আসে। টানা কয়েক দশক জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল। তবে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি বার্বি ডলের আমেরিকান বিউটি স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ছাঁচিবদ্ধ শারীরিক গঠন, আঁটসাঁট ছোট পোশাক, ‘হোয়াইট’ এথনিসিটি নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। বার্বিকে ফেমিনিস্ট আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এর প্রস্তুতকারক কোম্পানি ম্যাটেলও কম যায়নি। একের পর এক বিভিন্ন পেশার, গঠনের, জেন্ডারের, এথনিসিটির ডল বাজারে আনতে শুরু করে। ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক, বিজ্ঞানী; সাদা, কালো, হলুদ সব বর্ণের সব ডল। এমনকি নাসার কোনো নারী প্রথম মহাকাশে যাওয়ার আগেই বার্বি ডলের মহাকাশবিজ্ঞানী ভার্সন বাজারে আনে ম্যাটেল। এত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সেই ডলের গোলাপি জগৎ আর গঠনকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্কের নিরসন ঘটেনি। একবিংশ শতাব্দীতে, মারগট রবির চেহারায় জীবন্ত বার্বিকে হাজির করে সেই প্লাস্টিক ডলকে যেন দেওয়া হলো পুনর্জন্ম!
পরিচালক বার্বি সিনেমায় বেশ চতুরতার সঙ্গে ব্যঙ্গাত্মকভাবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিপরীতে মাতৃতান্ত্রিক এক ইউটোপিয়ান বার্বি-ল্যান্ড দেখিয়েছেন, যেখানে ম্যাটেল কোম্পানির তৈরি করা প্রতিটি ডল ভার্সন বসবাস করে তাদের নিজ নিজ প্লাস্টিক হাউসে। অনাবিল আনন্দে ভরা তাদের জীবন। কোনো ঘাটতি নেই, খুঁত নেই, সমস্যা নেই। সিনেমার শুরুতেই বার্বি-ল্যান্ডের পরিচিতিতে ন্যারেটর (হেলেন মিরেন) এসব বলে দেন। বার্বিল্যান্ডে বার্বিরাই সবকিছু। ন্যারেটরের ভাষায় ‘Barbie can be anything, women can be anything।’ প্রতিদিনই বার্বি নোবেল প্রাইজ পাচ্ছে; হাসি, আনন্দ, ফুর্তির নির্ভার আর জাঁকজমকপূর্ণ বিলাসী জীবন করছে; ‘পারফেক্ট’, ‘স্টেরিওটাইপ বিউটি’ আছে তার; আছে ‘কেন’ও যার জীবন ধন্য হয়ে যায় বার্বির একনজর দৃষ্টিতে। তবে ‘কেন’ সেখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সিনেমায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিপরীতে এভাবে মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার চিত্রায়ণ করে পরিচালক যেন অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হলে, নারীর হাতেই কর্মক্ষেত্র, ক্ষমতা, সফলতা, প্রাচুর্য থাকলে নারীর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় কি না। কিন্তু দেখা যায় নিখুঁত জীবনের অন্তরালেও বার্বির মনে মৃত্যুর ভয়, জীবনের অর্থ খোঁজার চিন্তা। ‘Everyday is the best day’, ‘Stereotypical beauty’, ‘Perfect life’ থাকার পরও বার্বি হারায় তার হাই হিল পরার পায়ের মাপ, নেমে আসে ‘ফ্ল্যাট ফিট’–এ, শরীরে দেখা দিতে শুরু করে স্ট্রেচমার্ক। এখান থেকেই মূলত বার্বির জীবনের অর্থ খোঁজার অভিযান শুরু হয়। বার্বি চলে আসে মনুষ্য সমাজে। এসে দেখে সমাজ এখানে পুরুষতান্ত্রিক, অথচ সে জানত নারীবাদের সব সমস্যার সমাধান সে করে ফেলেছিল। বিশাল এক সংকটে পড়ে যায় সে। অন্যদিকে বার্বির সফরসঙ্গী কেন খুঁজে পায় পুরুষতন্ত্রের মন্ত্র। বার্বিল্যান্ডে ফিরে ঘটিয়ে ফেলে বিপ্লব, প্রতিষ্ঠা করে তার নিজস্ব ‘মোজো ডোজো কাসা হাউস’। বার্বির সংকট আরও ঘনিয়ে আসে ফিরে এসে সে যখন জানতে পারে তার সাম্রাজ্য ‘কেন’ দখল করে নিয়েছে। বার্বি হাল ছেড়ে দিতে চায়, যখন দেখতে পায় সব বার্বিকেই কেনরা ‘লয়াল সার্ভেন্ট’–এ পরিণত করেছে। বার্বি মনে করে সে ‘যথেষ্ট’ না, ‘পারফেক্ট’ না, এবং এ কারণেই এত সব ঘটেছে। এখানেই আমেরিকা ফেরেরা অভিনীত গ্লোরিয়া চরিত্র বার্বির উপলব্ধিতে সহায়তায় এগিয়ে আসে।
বার্বিল্যান্ড এবং বাস্তবের জগতের অসংগতিগুলো সমান্তরালভাবে উঠিয়ে এনে পরিচালক পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অবচেতনে যত অবধারণগত অসংগতি রয়েছে, তার দুর্দান্ত বিশ্লেষণ করেছেন। আধুনিক সমাজে নারীর অগ্রগতি অনেকটাই অর্জিত হলেও তার কাছে সমাজের যে অবাস্তব প্রত্যাশা তা তুলে এনছেন। নারীকে স্লিমও হতে হবে তবে ঘরে-বাইরের সব কাজ সমানভাবে সামলানোর শক্তিও থাকতে হবে, ফর্সা-সুন্দর গঠনের হতে হবে তবে সব পুরুষকে অ্যাট্রাক্ট করে ফেলে এমন না, আবেগ ও যুক্তি একই সঙ্গে ধারণ করতে হবে, স্মার্ট-ইন্টেলিজেন্ট হতে হবে তবে তা যেন পুরুষকে ভয় পাইয়ে বা চিন্তায় না ফেলে দেয়, নারীরা হবে পারফেক্ট তবে নম্র ও নিরহংকারী, সব সময় সবকিছু নিয়ে সন্তুষ্টও থাকবে আবার সিস্টেমের পক্ষপাত সম্পর্কেও সচেতন হবে এ রকম হাজারো পরস্পরবিরোধী সামাজিক প্রত্যাশার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। একই সঙ্গে এ ধরনের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আদর্শ যে পুরুষদের টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি, অসুস্থ ইগো রক্ষার প্রতিযোগিতা তৈরি করে এবং তাদের নিপীড়ক হয়ে উঠতে সহযোগিতা করে, সে ব্যাপারটিও পরিচালক উঠিয়ে এনেছেন।
সিনেমায় বার্বি শেষ পর্যন্ত তার কাছে সমাজের যে অবাস্তব প্রত্যাশা, তা বুঝতে সক্ষম হয় এবং কেনকেও জীবনের মানে খুঁজে পেতে সহায়তা করে। নিরপেক্ষ একটা জায়গা থেকে বিষয়গুলো দেখার সুযোগ করে দিয়ে পরিচালক যেন দর্শককেও বাধ্য করেছেন একধরনের আত্ম অনুসন্ধানে যেতে। সিনেমার প্রায় শেষের দিকে গ্লোরিয়া চরিত্রের গুজবাম্পদেয়া মনোলগটির মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে বার্বি যেমন ফিরে পায় নিজেকে, তেমনি দর্শকেরও আত্ম অনুসন্ধানের ক্লাইমেক্স মেলে।
মূলত গ্রেটা গারউইগের সিনেমায় বার্বির অস্তিত্ব সংকট, ম্যাটেলের বার্বি ডলের বাজার সংকট আর ফরাসি দার্শনিক আলবার্ট কামুসের অ্যাবসারডিজম দর্শন একটা পয়েন্টে মিলে যায়। কামুসের ধারণামতে একটি অর্থহীন জগতে মানুষের জীবনের অর্থ খোঁজার চেষ্টা, সিনেমায় বার্বির একটা ইমপারফেক্ট জগতে পারফেকশন খোঁজার প্রচেষ্টা আর ম্যাটেল কোম্পানির একটা সাম্যপ্রত্যাশী সমাজে অকল্পনীয় বিউটি স্ট্যান্ডার্ড আর ছাঁচে ফেলা ডলকে নারীবাদী আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা একটা ত্রিমুখী অ্যাবসারডিটির জন্ম দেয়! আর এই অ্যাবসারডিটি নিরসনের চেষ্টা করেছেন পরিচালক গেটা গারউইগ।
তবে এর বুদ্ধিদীপ্ত স্ক্রিপ্ট আর গ্রেটার প্রচেষ্টা বার্বিকে বার্বি ডল নিয়ে বিতর্ক নিরসন করতে চাওয়া কোনো বিজ্ঞাপনী পণ্য হয়ে উঠতে দেননি; বরং বার্বি ডলের পক্ষে-বিপক্ষে বাস্তবের সব আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্কগুলোকে সিনেমাতে উঠিয়ে এনে বিচারের ভার ছেড়ে দিয়েছেন দর্শকের হাতে।
মারগট রবির দুর্দান্ত অভিনয়, বিচিত্র আবেগকে ফুটিয়ে তোলার অসাধারণ ক্ষমতা, রায়ান গুজলিংয়ের পুরুষতান্ত্রিক জটিলতাগুলোর কমেডিক উপস্থাপন, সিনেমায় বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিগুলোকে ফুটিয়ে তুলতে বিভিন্ন এথনিসিটির কাস্টিং সিনেমাটিকে করেছে অনন্য ও বৈচিত্র্যপূর্ণ।
*লেখক: নাসরিন আক্তার: সহকারী অধ্যাপক, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ