পরিবেশবান্ধব হোক বিশ্ব পরিবেশ দিবস
আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। মানুষের মধ্যে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিই এ দিবসের মুখ্য উদ্দেশ্য। ফলে প্রতিবছর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নিয়ে দিবসটি পালিত হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘করব ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখব মরুময়তা, অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা’। ইউএনইপির নেতৃত্বে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ১৫০টির বেশি দেশ এ দিবস পালন করে থাকে। এ বছর (২০২৪) বিশ্ব পরিবেশ দিবসের বৈশ্বিক উদ্যাপনের আয়োজন করেছে সৌদি আরব।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও ভূমি পুনরুদ্ধার, মরুময়তা ও খরার সঙ্গে অভিযোজনের ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে এ বছর দিবসটি পালন করছে। বাংলাদেশের জন্য পরিবেশ দিবস খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ, বাংলাদেশ একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ভুক্তভোগী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, অন্যদিকে পরিবেশদূষণের কোনো কোনো ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়নও বটে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান নিয়ামক কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা নগণ্য হলেও পরিবেশ ধ্বংস ও দূষণের ক্ষেত্রে একেবারে প্রথম কাতারে।
বিতর্কে না গিয়ে বলা যায় বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ও চিন্তার বিষয় হলো পরিবেশ। পরিবেশবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষ ও তাদের পরিবেশের মধ্যকার সম্পর্ককে বোঝার জন্য তিনটি উপায় রয়েছে। প্রথমত, মানুষ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয় এবং সে জন্য তার পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে বেড়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, মানুষ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয় নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য এবং সে জন্য পরিবেশকে নিজের মতো নির্ধারণ করে অথবা আকৃতি প্রদান করে। তৃতীয়ত, মানুষ ও পরিবেশের মধ্যে এ রকম মিথস্ক্রিয়া ঘটে যেন তারা একে অপরকে গড়ে তোলে।
এখন পর্যন্ত একমাত্র পৃথিবীতেই মানব বসবাসের উপযোগী পরিবেশ রয়েছে। কিন্তু মানুষের নির্বিচার কর্মকাণ্ডের জন্য ক্রমেই পৃথিবীর পরিবেশ দূষিত হয়ে মানব বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। কয়েক বছর ধরে পরিবেশে অনেক অস্বাভাবিক ও নজিরবিহীন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলো প্রকৃতির প্রধান উপাদান যেমন পানি, বন, ভূমি ও সমগ্র বায়ুমণ্ডলকে প্রভাবিত করছে। এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এতটাই তীব্র যে পৃথিবীর অস্তিত্ব, এর বায়ুমণ্ডল এবং সমগ্র জীবজগতের অস্তিত্বই সংকটের মুখে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘তপোবন’ প্রবন্ধের উক্তিটি হলো, ‘মানুষকে বেষ্টন করে এই যে জগৎপ্রকৃতি আছে, এ যে অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে মানুষের সকল চিন্তা সকল কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে। মানুষের লোকালয় যদি কেবলই একান্ত মানবময় হয়ে ওঠে, এর ফাঁকে ফাঁকে যদি প্রকৃতি কোনো মতে প্রবেশাধিকার না পায় তাহলে মানব চিন্তা ও কর্ম ক্রমশ কলুষিত ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে নিজের অতল-স্পর্শ আবর্জনার মধ্যে আত্মহত্যা করে মরে।’
নগরায়ণ, শিল্পায়ন, যানবাহনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, বন উজাড়, বায়ু-পানি-মাটি দূষণ, জৈব বর্জ্যের পচন প্রভৃতি কারণে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইদানীং বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার অধিবাসীদের জন্য গ্রীষ্মকাল বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ৬৬ শতাংশ মানুষ অতি উচ্চ তাপমাত্রার ঝুঁকিতে আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে যে সমস্যাটি সবচেয়ে গুরুতর আকার ধারণ করেছে, তা হলো তীব্র তাপপ্রবাহ। সিইজিআইএসের তথ্যানুযায়ী গত তিন দশকে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৪ গুণ। বর্তমানে উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা দেশের আবহাওয়াকে বিপজ্জনক করে তুলেছে। এ তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। গবেষকেরা বলেছেন, বাংলাদেশের তাপমাত্রা বাড়ার পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব ৩৭ শতাংশ, বাকি ৬৩ শতাংশের পেছনে স্থানীয় কারণ রয়েছে।
মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলাধার ও সবুজায়ন কমে যাওয়াকে পরিবেশবিজ্ঞানীরা তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিবেচনা করছেন।
এ ছাড়া দেশের নগরগুলোতে তাপপ্রবাহের প্রভাব বেশি অনুভূত হওয়ার অন্যতম কারণ ইট, পাথর, কংক্রিট ও থাই গ্লাসের ঘন জঙ্গল। নগরে ইট, পাথর, কংক্রিট ও অ্যালুমিনিয়ামের অবকাঠামো যত বেশি থাকে, তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে তত বেশি অনুভূত হয়। কারণ, এসব অবকাঠামো যেমন দ্রুত তাপ শোষণ করে, তেমনি তাপ ত্যাগ করতেও অধিক সময় নিয়ে থাকে। পাশাপাশি দেশে অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষ নিধনে ক্রমান্বয়ে দেশে মরুময়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে মধ্যম থেকে উচ্চমাত্রার খরায় আক্রান্ত ভূমির পরিমাণ ৫৫ লাখ হেক্টর। কোনো বিরতি না দিয়ে জমিতে পরপর বিভিন্ন ফসলের চাষ করা, প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও নানা কারণে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভূমির অবক্ষয় হচ্ছে। যা দীর্ঘ মেয়াদে মরুময়তা সৃষ্টি করতে পারে। এ থেকে বাঁচার জন্য ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপণ, খাল-নদী খনন ও জলাশয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তবে দেশে এর উল্টো চিত্র দেখা যায়। পরিবেশ রক্ষায় বনভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। হিসাব অনুযায়ী, পরিবেশ সুরক্ষার জন্য একটি দেশের আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা অপরিহার্য। অথচ দেশে বর্তমানে বনভূমির পরিমাণ মোট ভূমির ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। বাংলাদেশে ২০৩০ সালের মধ্যে বনভূমির পরিমাণ ১৬ শতাংশ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। অর্থাৎ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল, কমছে জীববৈচিত্র্য। এ ছাড়া দেশে প্রতি আড়াই বছরে একবার বড় ধরনের খরায় আক্রান্ত হয়।
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল মূলত খরাপ্রবণ এলাকা। দেশের এসব অঞ্চলে খরাকবলিত হয়ে ক্রমান্বয়ে ভূমির অবক্ষয় হচ্ছে। তাই বৃক্ষরোপণ খরা ও মরুময়তা রোধে সর্বাধিক কার্যকর উপায় ও পদক্ষেপ। এ ছাড়া খরার প্রতি সহনশীলতা অর্জন করতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীনদের দ্বারা অবৈধ দখলকৃত ভূমি পুনরুদ্ধার করে তা ব্যবহার উপযোগী করা গেলে দেশের পরিবেশ সুস্থ হবে, সমৃদ্ধ হবে।
মূলত আমাদের জীবনধারণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার প্রায় সবকিছুই পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করি।
তাই আমাদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন বাঁচানোর তাগিদেই প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করা প্রয়োজন।
তা ছাড়া টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে এবং প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে পরিবেশ রক্ষা জরুরি। আর এ পরিবেশ সুরক্ষায় সচেতনতার মাধ্যমে যদি প্রকৃতি ও পরিবেশকে সুন্দর রাখা যায়, তবে বাঁচবে পৃথিবী, বাঁচবে মানবজাতি। এ জন্য প্রয়োজন পরিবেশবান্ধব চিন্তা–চেতনা। এ জন্য দেশের নব প্রজন্মকে এই কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা খুবই প্রয়োজন। সচেতনতা বৃদ্ধির যেমন বিকল্প নেই, একই সঙ্গে যারা পরিবেশদূষণের জন্য দায়ী, পরিবেশদূষণের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনে ব্যস্ত, তাদের কাছ থেকে যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণ আদায় করা আবশ্যক। এভাবে সব পর্যায়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলেই পরিবেশ দিবসের আসল উদ্দেশ্য অর্জিত হবে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর, বাংলাদেশ
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]