অনলাইনে খাদ্য ব্যবসায় শব্দফাঁদ: প্রতারণার নতুন কৌশল

বর্তমান যুগ আধুনিক প্রযুক্তির যুগ। এ যুগে ঘরে বসেই যেকোনো ধরনের পণ্য হাতে পাওয়া সম্ভব। বিশেষত ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়ে ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্যবহার করে সারা বিশ্বে নানা ধরনের পণ্য বিক্রি হচ্ছে। করোনার পর থেকে অনলাইনে পণ্য বিক্রি বেড়েছে বহুগুণে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্য বিক্রি বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। দেশে অনলাইনে খাদ্যদ্রব্য সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ফেসবুকে। মূলত ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ, আইডি ও গ্রুপের মাধ্যমে সব ধরনের খাদ্যপণ্য বিক্রি করা হয়। যেহেতু এফ কমার্স (ফেসবুক কমার্স) একটি নতুন ধারণা, তাই এখনো এফ কমার্সের নানা ধরনের ফাঁকফোকর রয়েছে, আর এসব ফাঁকফোকরের মধ্য দিয়ে ব্যবসায়ীরা প্রতারণার নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার করছেন। এ প্রতারণা ভোক্তাদের যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তেমনি ব্যবসায়ীরা হচ্ছেন আঙুল ফুলে কলাগাছ। খাদ্য ব্যবসায় প্রতারণার রয়েছে বিভিন্ন ধরন, এসব ধরনের মধ্যে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে ‘শব্দফাঁদ’ প্রতারণা। ওজনে কম দেওয়া কিংবা খাদ্যে ভেজাল দেওয়া এ রকম নানা ধরনের প্রতারণা অনেক আগে থেকেই দেশে প্রচলিত, তবে বর্তমান সময়ে অনলাইন ব্যবসা প্রসারের ফলে শব্দফাঁদ নামক প্রতারণা বাড়ছে।

আসলে এ ধরনের নতুন কৌশলকে শব্দ ফাঁদ প্রতারণা কেন বলছি, তা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। মূলত এ ধরনের প্রতারণার ক্ষেত্রে পণ্য বিক্রির সময় বেশ কিছু চটকদার শব্দ ব্যবহার করে ভোক্তাদের প্রতারিত করা হয়। এ ধরনের কয়েকটি শব্দ হলো প্রিমিয়াম, অর্গানিক, হালাল, ১০০ ভাগ খাঁটি, বিষমুক্ত, ন্যাচারাল ও ভেজালমুক্ত ইত্যাদি‌।

বর্তমান সময়ে ফেসবুকে স্ক্রল করার সময় আমরা দেখতে পাই, হাজারো ফেসবুক পেজ কিংবা গ্রুপ যেখানে প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। এবং প্রায় সবারই ব্যবসার মূল মন্ত্র হলো এ ধরনের চটকদার শব্দ ব্যবহার করে ভোক্তাদের কাছে এসব খাদ্যপণ্য বিক্রি করা। আমরা যাঁরা সাধারণ ভোক্তা আছি, তাঁরা অসচেতন হওয়ার কারণে তাঁদের এসব চটকদার শব্দ ফাঁদে পড়ে এসব পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছি প্রতিনিয়ত। পত্রিকা খুললে আমরা দেখতে পাই, এসব প্রতারণার খবর। তবে অনেকে প্রতারণা ছাড়াই ভালো ব্যবসাও করছেন।  

আমরা মূলত এসব শব্দ ব্যবহারের কারণে ধরেই নিচ্ছি খাদ্যটি আসলে প্রিমিয়াম কিংবা অর্গানিক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেশে প্রিমিয়াম, অর্গানিক কিংবা শতভাগ বিশুদ্ধ খাবার বাজারে নিয়ে আসা বেশ দুরূহ এবং ব্যয়বহুলও বটে। যদিও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়াম কিংবা অর্গানিক খাবার বাজারজাত করছে, তবে সেটার সংখ্যা খুবই কম।

বেশ কিছু ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে যে অনলাইনে বিভিন্ন খাবার নিয়ে ব্যবসা করে এবং তাঁর খাবারগুলোতে প্রিমিয়াম, অর্গানিক, হালাল কিংবা শতভাগ খাঁটি এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করে সেটি হাইলাইট করে বাজারজাত করে কিন্তু প্রিমিয়াম, অর্গানিক কিংবা শতভাগ খাঁটি এসব শব্দ দিয়ে আসলে কি বুঝায় বা প্রিমিয়াম, অর্গানিক কিংবা শতভাগ খাঁটি খাদ্যপণ্য হতে গেলে কি কি শর্ত মেনে চলতে হয়, সেসবের অনেক কিছুই জানেন না। বেশিরভাগ অনলাইন খাদ্য ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রেই এমনটি দেখা যায়।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা এসব শব্দ ব্যবহার করে শব্দফাঁদ তৈরি করছেন আর সেই ফাঁদেই আমরা পা দিচ্ছি। সেসব প্রতারক ব্যবসায়ীর নানা ধরনের খাদ্য পণ্য আমরা কিনে খাচ্ছি। ফলাফলস্বরূপ আমাদের দেহে নানা ধরনের জটিল রোগ দেখা দিচ্ছে কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না।

সাম্প্রতিক সময়ে ফাংশনাল ফুডস (যেসব খাবারর ঔষধি গুণাগুণ আছে) ও নিউট্রাসিউটিক্যালস (যেসব খাবারের পুষ্টি ও ফার্মাসিউটিক্যাল গুণাগুণ আছে) এর বাজার প্রসারিত হচ্ছে খুব দ্রুত। তাই তো ফেসবুকে বিভিন্ন পেজে নানা ধরনের ফাংশনাল ফুডস ও নিউট্রাসিটিক্যালস–জাতীয় খাদ্য বিক্রি হচ্ছে, যেমনটি আমরা দেখতে পাই হানিনাটস কিংবা সজিনা পাতার ক্ষেত্রে। শুধু বিক্রেতাদের শব্দফাঁদের কৌশলে এই দুটি পণ্য দেদারসে বিক্রি হচ্ছে অনলাইন মার্কেটে। আর এই সুযোগকে ব্যবহার করে প্রতারণা করছে অনেক অনলাইন ব্যবসায়ী।

শব্দফাঁদের বাইরেও আরও এক ধরনের প্রতারণা বাংলাদেশে শুরু হয়েছে এফ কমার্সের ক্ষেত্রে। সেটি হলো প্যাকেজিংয়ের রং পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতারণা। বিষয়টা একটু জটিল মনে হলেও আসলে খুবই সহজ। বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্যে যেসব প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হয়, সেগুলোকে ইকো ফ্রেন্ডলি ঘোষণা দিয়ে সেখানে সবুজ রঙের আধিক্য রেখে তৈরি করা হয়, যাতে ক্রেতারা খুব সহজে আকৃষ্ট হযন। কেন না সবুজ রং আমাদের চোখের জন্য প্রশান্তিদায়ক, তাই আমরা সবুজ রং দেখলেই সেদিকে বেশি আকৃষ্ট হই। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিম্নমানের খাদ্যপণ্যকে সবুজ রঙের জার কিংবা প্যাকেটে প্যাকেটজাত ও বাজারজাত করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা তৈরি করছে ব্যবসায়ীরা। ব্যাপারটি আপাতদৃষ্টিতে খুব ক্ষুদ্র মনে হলেও এটি আসলে ব্যবসায়ীদের জন্য বিশাল একটি সুযোগ।

এভাবে অনলাইন খাদ্য ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের অসচেতনতা কিংবা অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে প্রতারণা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এভাবে জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো অনলাইন খাদ্য ব্যবসার জন্য দেশে নির্দিষ্ট কোনো সরকারি নীতিমালা নেই কিংবা আইন নেই, যার মাধ্যমে এসব ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আবার যেটুকু নীতিমালা আছে, সেটা মানতে নারাজ এসব অনলাইন খাদ্য ব্যবসায়ীরা।

তাই কর্তৃপক্ষের উচিত অনলাইন ব্যবসা, বিশেষত খাদ্য ব্যবসার জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা, যা সব খাদ্যপণ্য ব্যবসায়ীরা মানতে বাধ্য থাকবেন। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনস, বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি ও গবেষণা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ইত্যাদি। সরকারের সব সংস্থা ও জনগণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে সুফল আসবেই। নিশ্চিত হবে নিরাপদ খাদ্য।

তাই আমাদের সকলের উচিত শব্দফাঁদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা, যাতে করে এসব অসাধু ব্যবসায়ীরা চটকদার শব্দ ব্যবহার করে খাদ্যপণ্য বিক্রি করতে না পারেন। আমরা নিরাপদ খাদ্য খেয়ে সঠিকভাবে জীবনযাপন করতে পারি এবং সুস্থ থাকতে পারি।
লেখক: প্রভাষক, খাদ্য প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ