রবীন্দ্রনাথ পাশে এসে দাঁড়িয়ে যান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শক্তি পাওয়ার জায়গা অনেক। প্রেরণা পাওয়ার উৎস অনেক। গান, নাটক, কবিতা, ছোটগল্প বা প্রবন্ধ—একেক সত্তা কথা বলে। উৎসবের গান, বিষণ্নতার গান, প্রেমের গান, বিরহের গান, দেশের গান, প্রকৃতির গান প্রভৃতি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় তাঁর গান। রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ ও ‘আমার সোনার বাংলা’ গান দুটি যথাক্রমে ভারত ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত। আলো আসে তাঁর প্রতিটি গান থেকে, শক্তি আসে তাঁর প্রতিটি গান থেকে। সব সময় তিনি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে যান। আমার সত্তায় মিশে যান যেন। আমার সত্তা হয়ে ওঠে ‘রবীন্দ্রনাথ’।
যেকোনো পরিস্থিতি ও পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের গানেই আশ্রয় নিতে হয়—বৃষ্টি-প্রেম-বিরহ অথবা গ্রহণে-বিদায়ে বিভিন্ন উৎসবে। সন্ধ্যাবেলার বিষণ্ন, নুয়ে পড়া আকাশ আবহে মনে পড়ে ‘তুমি রবে নীরবে’। ‘পুরানো সেই দিনের কথা,’ ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে,’ ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়,’ ‘সহে না যাতনা,’ ‘এ কী ল্যাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে’—এমন সুরের কোনো দেশ আছে? কাঁটাতার থাকে? স্রোতের বিপরীতে একলাই চলতে হয়। এটা সব সময়ের রীতি। ভালো কাজে সহযাত্রী পাওয়া কষ্টকর। তবুও লক্ষ্যপথে যাত্রা করতে হবে। প্রয়োজনে একাই যাত্রা শুরু করতে হবে। এখানেও রবীন্দ্রনাথ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে যান—‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।/ একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের গানের নীলকান্তমণি। বিভিন্ন পর্যায়ের গান আছে। একেকটি যেন আলাদা সত্তার। প্রেমিকের গান আছে, বিরহের গান, বিষণ্নতার গান, দেশের গান। সব সত্তাই মুগ্ধ করবে। রবীন্দ্রনাথের গানগুলো প্রেমিকার মতো। কখনো আড়াল রাখে, কখনো প্রকাশ্যে আসে। মনোমালিন্য থাকে কখনো, ভালোবাসার গভীরতাও বাড়ে কখনো। রবীন্দ্রনাথের গানগুলো মনে পড়লে অবধারিতভাবে গানের কথাগুলো ভেতরে ভেতরে গাঁথা হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের গানের মুখোমুখি হলে আমাদের মন ও ভার হালকা হয়ে যায়। দুঃখগুলো সব সরে যায়, মনের সংসার সাজিয়ে দেয়। গানের কথা, সুরের মোহ ‘দূরের কিছু নয়’ বলেই মনে হয়। বলতে ইচ্ছা করে, ‘আজি দখিন দুয়ার খোলা,’ ‘দখিন হাওয়া জাগো জাগো’ ইত্যাদি।
রবীন্দ্রসুরে একটা মগ্নতা থাকে। এ মগ্নতা প্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তা করে। একলা দিনে গাই রবীন্দ্রনাথের গান। প্রকৃতির মধ্যে থাকলে গাই তাঁর গান। বলা চলে, নিজের খুশির জন্যই, আনন্দের জন্যই আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাই। তাঁর বিষণ্নতার গানেও আমরা হিল্লোল পাই। চেতনায় শুধু রং লাগায়। মনে হয়, আমার জন্যই এ গান, এ পরিবেশের জন্যই এ গান লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। এ যেন রবীন্দ্রনাথ লেখেননি, আমিই লিখছি। রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে ভাষার পেলবতা দেখা যায়। তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। গানে নতুন ফর্ম এনেছেন। রেখে গেলেন, যা আগে ছিল না এমন। সঞ্চারীর অপূর্ব ব্যবহার করেছেন তিনি, সুরে জাদুমন্ত্র মিশিয়েছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রদ্ধার পাত্র, সমীহ করার মতো আধার। প্রণম্য তিনি। বিভিন্ন উৎসব আর পরিবেশের সামঞ্জস্যপূর্ণ গান আমার সত্তায় মিশে গিয়ে হয়ে যান ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’।
‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘনঘোর বরিষায়’—বর্ষা প্রেম ও বিরহের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে দেয়। বর্ষায় প্রেম ও বিরহের রসায়নটা জমে ওঠে। তাই দেখা যায়, ঋতুভিত্তিক (এমনকি একক বিষয়ে) বর্ষাকেন্দ্রিক সাহিত্য অনেক বেশি। মেঘ, বৃষ্টি নিয়ে বর্ষা। বর্ষাকেন্দ্রিক গানগুলো বা কবিতায় সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছাতে পেরেছেন। যখন এসব সাহিত্য পাঠ করা হয় বা উপভোগ করা হয় মনে হয় আমিই সেই সত্তা, যা আমি খুঁজেছি; কিন্তু পাইনি। বৃষ্টি ও মেঘের পরের মিষ্টি রোদ কী যে সুন্দর! ঝলমলে আলোয় দূরীভূত হয় সব মন্দ, দুঃখ-বেদনা। উল্লাসে ফেটে পড়ি—‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি।/ আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি’। প্রেয়সী বা প্রিয়জনের কথা মনে হলেই সুর চলে আসে মনে, হৃদয় দোলায়িত হয়। প্রিয়জন মনে রাখুক বা না রাখুক, তার কথা মনে পড়া প্রাণিজ সহজাত—‘মনে রবে কি না রবে আমারে সে আমার মনে নাই/ ক্ষণে ক্ষণে আসি তব দুয়ারে, অকারণে গান গাই’। এখানেও রবীন্দ্রনাথ।
‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী, অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি,’ ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে,’ ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে/ তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ,’ ‘আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে, চাও কি,’ ‘আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো’র মতো গানগুলো যখন শুনি তখন ভাবতে বাধ্য করে, চৈতন্যকে প্রসারিত করে। এসব গান গাইলেই নিজের সত্তা জাগ্রত হয়। আসলেই তো, আমি আমার মানসরাজ্যে আমিই রাজা! অন্যজন কেন নিয়ন্ত্রণ করবে! মঙ্গলের জন্য করতে পারে; কিন্তু আমাকে ধোঁকা দিয়ে নয়। আমি ইচ্ছা করেই তা করব, তা মানব।
রবীন্দ্রসুরে আচ্ছন্ন বাঙালি—কলকাতা-শান্তিনিকেতন-ঢাকা পর্যন্ত প্রবলভাবে বিস্তৃত। জন কিটসের কবিতার শব্দগুলো যেমন ঠোঁট, চোখ, মুখ, মাথায় সেনসেশন সৃষ্টি করে, তেমনি রবীন্দ্রনাথের গান ইন্দ্রিয়কে জাগ্রত করে প্রবলভাবে। বর্ষা উন্মাদনা জাগায়। যেন প্রথম প্রেমের মতো একটা কিছু। গভীরভাবে প্রকৃতির উপলব্ধি করা শেখায়। মৃত্যুভাবনা বা মৃত্যুচেতনা রবীন্দ্রনাথের অন্যতম দর্শন। মৃত্যু নিয়ে বেশ কিছু গান লিখেছেন তিনি। বিদায়বেলায় মৃত্যু নিয়ে আকার-ইঙ্গিতে অনেক গান-কবিতা লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ বিষণ্ন বেলাও উপভোগ করতে চাইতেন। জীবনকে সব সময় উপভোগের মধ্যেই রাখতেন। ব্যক্তিসত্তাকে অসীমের মধ্যে মিলিয়ে দেওয়া। এ দর্শন তাঁকে চিরঞ্জীব করেছে। কিছু উদাহরণ:
(১) শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?
আঘাত হয়ে দেখা দিল, আগুন হয়ে জ্বলবে।
(২) তোমার বীণার ধ্বনির সাথে আমার বাঁশির রবে
পূর্ণ হবে রাতি।
তোমার আলোয় আমার আলো মিলিয়ে খেলা হবে,
নয় আরতির বাতি।
(৩) মধুর, তোমার শেষ যে না পাই প্রহর হল শেষ—
ভুবন জুড়ে রইল লেগে আনন্দ-আবেশ।
দিনান্তের এই এক কোনাতে সন্ধ্যামেঘের শেষ সোনাতে
মন যে আমার গুঞ্জরিছে কোথায় নিরুদ্দেশ।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প বা উপন্যাস পড়লে মনে হয়, এ তো আমার আশপাশের ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ যেন আমার চোখে দেখেছেন। আমার বাড়ির ঘটনা, আমি বলতে চেয়েছি, কিন্তু বলতে পারিনি! লিখতে চেয়েছি, কিন্তু লেখার ক্ষমতা আমার নেই। শুধু রবীন্দ্রনাথ পেরেছেন। প্রকাশ করতে পেরেছেন, লিখতে পেরেছেন। বর্ণনাগুলো আমি না করে রবীন্দ্রনাথ করেছেন। রবীন্দ্রনাথে বিলীন হয়ে যায় আমি। রবীন্দ্রনাথের সত্তা আমার সত্তা হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা আছে, যা পাঠ করলে কাঁটাতার আছে বলে মনে হয় না! সমগ্র বাঙালি একই সূত্রে গাঁথা হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ আমার হয়ে যান।
রবীন্দ্রনাথের গানগুলো সৌন্দর্যের বড় আধার। এ আধার থেকে সবাই সৌন্দর্য নিয়ে নিলে বা উপভোগ করলেও শেষ হয়ে যায় না! তাঁর গানে ধরা দেয় প্রকৃতি, ধরা দেয় প্রেম, ভেসে ওঠে একাকিত্ব বা বিরহ। ছাড়িয়ে যায় কিটসের A Thing is joy forever-কেও। পঞ্চইন্দ্রিয়ের সব নন্দনকানন গড়াগড়ি খায় আমার চারপাশে, আলতো-স্পর্শ করে স্বপ্নে বেঘোর করে। জাগিয়ে দেয় সুন্দরের ডালি। মনে হয়, এই তো রবীন্দ্রনাথ, এই তো আমি! আমিই ‘রবীন্দ্রনাথ’। রবীন্দ্রনাথ দেবদূত, না হলে আমার মনের খবর জানলেন কী করে! দেবদূত তো দেখা যায় না! দেবদূত আমার দেহেই মিশে আছে। রবীন্দ্রনাথ-সাগরে যতই ঢুকে পড়ি ততই বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, চলে যায় অন্য এক আনন্দলোকে। তাঁর সাহিত্যসাগর থেকে ‘সিন্ধু সেচে বিন্দুর মতো মুক্তা আনি’ যেন। তিনি রাজনীতি, জনসংস্কৃতিতে মিশে গেছেন। মিশে গেছেন বাঙালির উৎসবে, পার্বণে। এই প্রভাবকে মাড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।
রবীন্দ্রনাথের গানগুলো কী মোহঘোরে ডুবিয়ে দেয়, সুন্দরের খনিতে নামিয়ে দেয়! রবীন্দ্রনাথে আচ্ছন্ন না হয়ে পারা যায়! কেউ এড়িয়ে যেতে পারবে? এড়িয়ে গেলেই অদৃশ্য রক্তক্ষরণ হবেই। রাজা চতুর্দশ লুই বলেছিলেন, I am the state—আমিই রাষ্ট্র। আমি শুধু রাষ্ট্রকেই চাই না। সমাজ-সংস্কৃতিকেই চাই। রবীন্দ্রনাথ হচ্ছে সংস্কৃতির বৃহত্তম উৎস। এখানে বাঙালির সব আছে। তাই বাঙালি হিসেবে আমাকে বলতেই হচ্ছে (আমাকে বদলে বাঙালিকেও বসাতে পারেন), আমিই রবীন্দ্রনাথ। তাই আমি ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’।
লেখক: প্রাবন্ধিক