নগরের নৈঃশব্দ্য হারাচ্ছে, ফিরিয়ে আনা কি সম্ভব

একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অফিসের উদ্দেশে বের হলেন। চারপাশ শান্ত, নেই কোনো গাড়ির শব্দ, নেই কোনো হর্ন, এই শান্ত পরিবেশে আপনি হেঁটে অফিসে গেলেন। উপলব্ধির সময়টা হবে উপভোগ্য। হঠাৎ স্বপ্ন ভেঙে গেল এবং ঘুম থেকে উঠে দেখেন সেই চিরপরিচিত শব্দদূষণ, গাড়ির সেই চিরচেনা হর্ন আপনার কানে বেজেই যাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে সেই ক্লান্ত ভাব যেন কাটছেই না। আমাদের সবার স্বপ্ন যেন এক হর্নমুক্ত, শব্দদূষণমুক্ত ঢাকা। আসলেই কি শব্দদূষণমুক্ত ঢাকা সম্ভব!

প্রতিবছর এপ্রিল মাসের শেষ বুধবার পালিত হয় আন্তর্জাতিক শব্দদূষণ সচেতনতা দিবস। ২০২৫ সালে দিনটি পড়েছে ৩০ এপ্রিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিবস উপলক্ষে মানুষকে শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা হয়। বাংলাদেশ, বিশেষত ঢাকা মহানগরীর প্রেক্ষাপটে দিবসটির গুরুত্ব অনেক বেশি।

শব্দদূষণ আমাদের চারপাশে এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যে আমরা অনেক সময় তা উপলব্ধিই করি না। অত্যধিক শব্দ শুধু অস্বস্তির কারণই নয়, এটি স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক হুমকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দিনের বেলায় ৬৫ ডেসিবেলেরর বেশি শব্দ দীর্ঘ মেয়াদে শ্রবণশক্তি, হৃদ্‌রোগ, মানসিক স্বাস্থ্য ও ঘুমের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ঢাকার ৯৭% এলাকা শব্দদূষণের মাত্রা অতিক্রম করেছে, যা শহরবাসীর স্বাস্থ্যের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের ২০২৫ সালের মার্চ মাসের এক গবেষণায় দেখা যায়, আসাদ গেটের পুলিশ বক্সের সামনে সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা ছিল ১৩০ ডেসিবেল, সর্বনিম্ন ছিল ৭২ ডেসিবেল এবং বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা ছিল ১১৫ ডেসিবেল, সর্বনিম্ন ছিল ৬৮ ডেসিবেল।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকা শহর বিশ্বের সবচেয়ে শব্দদূষণযুক্ত নগরী, যেখানে গড় শব্দমাত্রা ছিল ১১৯ ডেসিবেল, যা গ্রহণযোগ্য মাত্রার দ্বিগুণেরও বেশি। স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার ৮২ শতাংশ এলাকাতেই শব্দমাত্রা ৬০ ডেসিবেল ছাড়িয়ে যায়। রাজধানীর ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের ৬৫% শব্দসম্পর্কিত স্বাস্থ্যের সমস্যায় ভুগছেন, যার মধ্যে রয়েছে কানে কম শোনা, মাইগ্রেন, ঘুমের ব্যাঘাত ও উচ্চ রক্তচাপ।

শব্দদূষণের কারণে ঢাকার ১১ দশমিক ৭% মানুষ শ্রবণশক্তি হ্রাসজনিত সমস্যায় ভুগছেন। দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ শব্দমাত্রার সংস্পর্শে থাকলে অনিদ্রা, মানসিক চাপ এবং শিশুদের মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। বিশেষ করে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা এই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার ৬৫% ট্রাফিক পুলিশসদস্য শ্রবণ ও ঘুমজনিত সমস্যায় ভুগছেন।

২০০৬ সালে বাংলাদেশ সরকার শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা প্রণয়ন করে। সেখানে আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকার জন্য ভিন্ন ভিন্ন শব্দমাত্রার সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগের অভাবে শব্দদূষণ কমার বদলে বেড়েই চলেছে। শব্দদূষণ এমন এক দূষণ, যা আমরা চোখে দেখতে পাই না, কিন্তু এর প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদে শরীর ও মনে পড়ে। তাই শব্দদূষণ প্রতিরোধে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করতে হবে।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আমাদের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি, যেমন শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা এবং নিয়মিত মনিটরিং নিশ্চিত করা; জনসাধারণকে শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করতে গণমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো; যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ করা এবং নির্মাণস্থলে শব্দ নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি ব্যবহার করা; শহরের বিভিন্ন স্থানে শব্দমাত্রা পরিমাপের জন্য মনিটরিং স্টেশন স্থাপন করা; পরিবেশ সংরক্ষণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পাঠ্যক্রমে শব্দদূষণ–বিষয়ক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা।

আন্তর্জাতিক শব্দদূষণ সচেতনতা দিবস উপলক্ষে আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব শব্দদূষণ রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং পরিবেশবান্ধব আচরণ গ্রহণ করা। এই সমস্যা মোকাবিলায় সরকার, প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

নগরের নৈঃশব্দ্য আজ হারিয়ে গেলেও তা পুরোপুরি বিলীন হয়নি। যদি আমরা সচেতন হই, পরিকল্পিত নগরায়ণ করি আর প্রকৃতির জন্য একটু জায়গা রাখি, তাহলে এই শহর আবারও ফিরে পেতে পারে সেই শান্ত পরিবেশ।

  • লেখক: জাকারিয়া মোহাম্মদ ইমন, শিক্ষার্থী, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়