শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই দিন ছুটি কতটুকু যৌক্তিক

ফাইল ছবি: প্রথম আলো

করোনার ছোবল থেকে কিছুটা রক্ষা পেতেই শুরু হয় রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই বিশ্বব্যাপী শুরু হয় অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংকট। সংকটময় এ পরিস্থিতিতে দেশে জ্বালানি সাশ্রয়ে নানামুখী কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার।

যেমন সময়সূচি দিয়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং দেওয়া, সরকারি-বেসরকারি অফিসে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার চেষ্টা, কর্মঘণ্টা কমানো, রাত আটটার পর জরুরি দোকান ছাড়া অন্য দোকান বন্ধ রাখা ইত্যাদি।

দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা অফিসে বিদ্যুৎ ব্যবহার ২৫ শতাংশ কমানোর নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা অফিসগুলোকে সভা ও অনুষ্ঠান আয়োজন করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে গাড়ির জ্বালানি ব্যবহার ২০ শতাংশ কমাতে বলা হয়েছে। প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে।

এ ছাড়া ২২ আগস্ট বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা সরকারি অফিসের সময় এক ঘণ্টা কমানোর পাশাপাশি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন (শুক্র ও শনিবার) করেছে সরকার। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) প্রতিবেদনে পরিমার্জিত একটি সময়সূচির কথা বলেছে। এত দিন অধিকাংশ বিদ্যালয়ে, বিশেষ করে দুই পালায় চলা বিদ্যালয়ের একেকটি শ্রেণিতে ছয়টি ক্লাস হতো। আর বৃহস্পতিবার আরও কম ক্লাস হতো।

কিন্তু এখন ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দিনে সাতটি করে ক্লাস করতে হবে। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার অর্ধদিবসের পরিবর্তে পূর্ণদিবস ক্লাস হবে। রবি থেকে বৃহস্পতিবার ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে প্রতিদিন ৭টি করে সপ্তাহে মোট ৩৫টি ক্লাস পরিচালিত হবে। এক পালায় (শিফট) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাসের মোট ব্যাপ্তি হবে দিনে ৬ ঘণ্টা ১০ মিনিট।

এর মধ্যে সমাবেশের জন্য ১৫ মিনিট এবং বিরতির জন্য ৩০ মিনিটও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তবে দুই পালায় চলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দিনে মোট ব্যাপ্তি হবে ৫ ঘণ্টা ৫ মিনিট। এর মধ্যে ১৫ মিনিট সমাবেশের জন্য এবং ২০ মিনিট বিরতির জন্য থাকবে। এত দিন দুই পালায় চলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একেক পালার কর্মঘণ্টা ছিল ৫ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট। প্রথম পালা সকাল ৭টায় শুরু হয়ে শেষ হবে দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে। আর দ্বিতীয় পালা দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে শুরু হয়ে বিকেল ৫টা ২৫ মিনিটে শেষ হবে।

অন্যদিকে, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে প্রতিটি ক্লাসের ব্যাপ্তি হবে ৫০ মিনিট। বাংলা, ইংরেজি ও শাখাভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ের জন্য সপ্তাহে প্রতি বিষয়ে ৫টি এবং তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তির জন্য ৩টি ক্লাস হবে। অর্থাৎ সপ্তাহে মোট ২৮টি ক্লাস হবে। ঐচ্ছিক বিষয়ের জন্য পাঁচটি ক্লাস হবে। এ ক্ষেত্রে ঐচ্ছিক বিষয় আছে—এমন শিক্ষার্থীদের জন্য সপ্তাহে ৩৩টি ক্লাস হবে।

শিক্ষাবিদেরা বলেছেন, এ মুহূর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক নয়। কারণ, করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে প্রায় দুই বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীর পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ ছিল। করোনাকালে শিক্ষার্থীদের যে শিখনঘাটতি হয়েছে, সেটি পূরণের বিষয়ের ওপর এখন বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

বরং এখন শিখনঘাটতি পূরণে যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়ন জরুরি। তবে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে শিখনঘণ্টা ঠিক করে আগামী বছর থেকে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা ঠিক আছে বলে তাঁরা মনে করেন।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে টানা প্রায় ১৮ মাস সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি পাঠদান বন্ধ ছিল।

যদিও বন্ধের ওই সময়ে টেলিভিশন, রেডিও ও অনলাইনে ক্লাস নেওয়াসহ নানাভাবে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখার চেষ্টা ছিল। তবে এসব কার্যক্রমে প্রত্যন্ত এলাকার বেশির ভাগই শিক্ষার্থী সমানভাবে অংশ নিতে পারেনি এবং অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।

সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের (বেডু) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, করোনা মহামারিকালে ২০২১ শিক্ষাবর্ষে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের (বর্তমানে নবম শ্রেণিতে পড়ছে) অর্ধেকেরও বেশির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে মধ্যম ও উচ্চ মাত্রায় শিখনঘাটতি তৈরি হয়েছে। গবেষণায় শিক্ষার্থীদের এই শিখনঘাটতি পূরণ করার কথা বলা হয়। তবে জেলাভিত্তিক বিবেচনায় পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলায় (বান্দরবান, রাঙামাটি,খাগড়াছড়ি) শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতি আরও খারাপ।

বেডুর এ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) মাধ্যমে শিক্ষার ঘাটতি পূরণে বিস্তারিত একটি কর্মপরিকল্পনা করে। শিক্ষার ঘাটতি পূরণের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন উপলক্ষে এনসিটিবি বলেছে, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাংলায় ১৫টি, ইংরেজিতে ১৭টি ও গণিতে ১৫টি মিলিয়ে মোট ৪৭টি অতিরিক্ত ক্লাস পরিচালনা করতে হবে। আর রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে যেহেতু ঘাটতি থাকা শিক্ষার্থীর হার অনেক বেশি, তাই ওই সব এলাকার জন্য আরও বেশিসংখ্যক অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে।

শিক্ষাবিদেরা বলেছেন, বেডু কেবল অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ওপর গবেষণাটি করেছে এবং প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কিন্তু করোনাকালে শিখনঘাটতি হয়েছে প্রায় সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের।

এ ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখার এক প্রতিবেদনের তথ্য বলেছে, করোনা মহামারির মধ্যে গত বছর দেশের  মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী—যা মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেকের বেশি—বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল।

তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে এবং শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী। আর অন্যদের অনুপস্থিতির সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি।

দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী পথভ্রষ্ট, অনেকেই তো ভুলেই গিয়েছিল তারা শিক্ষার্থী। গবেষণা সমীকরণ বলে, অনেক শিক্ষার্থী ঝরে গেছে; তবে বাস্তবতার কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে অনেককেই। ধনী-গরিব বাবার অনেক সন্তান হয়েছে মাদকাসক্ত।

ঝরে গেছে অনেক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। হতভাগা অভিভাবকেরা দিশেহারা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তবু যখন শিক্ষার্থীরা নিজের পড়ালেখার দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছে নতুন করে, এ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই দিন ছুটি খুব বেশি যৌক্তিক নয়।

লেখক: নাজিম হোসেন, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া