বেপরোয়া কিশোর গ্যাং, সমাধান কী?
সম্প্রতি বাংলাদেশ সমাজে নতুন সংকটের নাম কিশোর গ্যাং। দেশে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। একে অপরের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে কয়েকজন কিশোর মিলে পাড়া বা মহল্লায় বিভিন্ন নামে (স্টার বন্ড, লেভেল হাই, নাইন স্টার, বিচ্ছু বাহিনী ইত্যাদি) বাহিনী গড়ে তুলছে। মূলত হিরোইজমের চিন্তাভাবনা থেকে কিশোরদের মধ্যে গ্যাং কালচার শুরু হলেও এখন তারা ভয়ংকর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
সাধারণত নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, মাদক, প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে বিরোধের কারণে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। এসব কিশোররা এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ খুন, ধর্ষণ, মারামারি, মাদক ব্যবসা, জমি দখলে সহায়তা, ইন্টারনেট সংযোগ, কেব্ল টিভি ব্যবসা, নারীদের উত্ত্যক্ত, যৌন হয়রানি, হামলা, মারধরসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এসব কর্মকাণ্ডে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, অপরাধ কর্মকান্ডের অনুকরণ, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনীতিবিদদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার ফলে এসব গ্যাং দিন দিন ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। বিশেষ করে শহর এলাকায় মানুষের নিরাপদ বসবাসের ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে উঠেছে এসব গ্যাং।
ইউনিসেফের মতে, দেশে কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকেই তৎকালীন পূর্ববঙ্গে কিশোর অপরাধ সংঘটিত হওয়ার তথ্য মেলে। তবে নব্বইয়ের দশক থেকে নগরায়ণ, শিল্পায়নের গতি বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্যানুযায়ী ঢাকা শহরে যারা অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের ৪০ শতাংশই কিশোর। আর কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির মাধ্যমে গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং কালচার। জানা যায়, ২০১৮ সালে উত্তরায় ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র আদনান খুন হওয়ার পর দেশে গ্যাং কালচার শব্দটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে শব্দটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি জানা যায় ২০১৯ সালে। ওই বছর বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাত শরীফ নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। রিফাত হত্যার পর জানা যায়, বরগুনা শহরে ০০৭ নামে একটি গ্যাং আছে। ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপে এর সদস্য ছিল ১০৬ জন। গ্যাংয়ের প্রধান ছিলেন সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ড।
সাধারণত একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, একই পাড়া-মহল্লার বাসিন্দা বা বখে যাওয়া কিশোর–তরুণেরা একজোট হয়ে বাহারি বা চটকদার নামে কিশোর গ্যাং তৈরি করে। কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা পর্যায়ক্রমে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী তৈরি করে। তাদের একটি দলীয় নাম, একটি স্থান, আলাদা ড্রেস কোড থাকে, চুলের স্টাইল থাকে, তাদের চালচলনও ভিন্ন। নামে কিশোর গ্যাং হলেও এসব বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যের গড় বয়স ১৮ বছরের বেশি। জানা যায়, কিশোর গ্যাংয়ে জড়িত সদস্যদের গড় বয়স ১৭ বছর। এদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান ও স্কুলপড়ুয়া ছাত্র। এ ছাড়া নিম্ন মধ্যবিত্ত ও লেখাপড়া না জানা কিশোর-তরুণও এ দলে আছে। পুলিশ প্রতিবেদন-২০২২ অনুযায়ী, দেশে অন্তত ১৭৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধে এদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৭৮০টি। এসব মামলায় আসামি প্রায় ৯০০ জন। অন্য এক হিসাবমতে, দেশে ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত কিশোর গ্যাং-বিষয়ক ৩২৫টি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলা সূত্রে ১১০টি গ্যাংকে শনাক্ত করা গেছে, যাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১ হাজার। ওই সময়ে ঢাকা মহানগর এলাকায় প্রায় ৫৪টি কিশোর গ্যাংয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলোর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭১০।
গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সব বিভাগ, জেলা, থানা ও মেট্রোপলিটন এলাকায় গড়ে ওঠা অন্তত ৫ থেকে ৬ হাজার কিশোর গ্যাং সদস্যের দাপটে ও আতঙ্কে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে গ্রাম-গঞ্জ, পাড়া-মহল্লা, হাট-বাজার, শহর-বন্দর সর্বত্র। এক হিসাব অনুযায়ী শুধু রাজধানীতে কিশোর গ্যাং রয়েছে ৬৬টি। চট্টগ্রামে ৫৭টি এবং মহানগরের বাইরে ঢাকা বিভাগে রয়েছে ২৪টি। এসব বাহিনীর বেশির ভাগের সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ৫০ জন। ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।
এসব গ্যাং এক দিনে গড়ে ওঠেনি। সাধারণত কিশোরদের মধ্যে ‘অ্যাডভেঞ্চার ফিলিং’ বা ‘হিরোইজম’ ভাব দেখা যায়। ত্রুটিপূর্ণ সামাজিকীকরণ, নেতৃত্ব ও ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা, সামাজিক বৈষম্য ও বঞ্চনা, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ধরনের গ্যাংয়ের জন্ম দিচ্ছে। সমাজ মনোবিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল টার্ডের ধারণা, অনেক সহজ-সরল, নিরপরাধ কোমলমতি কিশোর অপরাধীকে অনুকরণ করে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে। তার মতে, অনুকরণের প্রথম শিকার হয় নবীনেরা এবং তারা সহজেই অপরাধের ফাঁদে পড়ে। টেলিভিশন, ভিডিও, সিনেমা, নাটক, ওয়েব সিরিজ, ইউটিউব ইত্যাদির মাধ্যমে কিশোরদের মনস্তাত্ত্বিক, চিন্তাভাবনা, দর্শন আকর্ষণ সহজেই পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এভাবে অনেক কিশোর অপরাধ জগতে প্রবেশ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বেশির ভাগ পরিবারের সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের তেমন মনোযোগ নেই। তারা নিজ পেশা তথা অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত। কারণ, তাঁরা সমাজে অর্থবিত্তশালীদের মূল্যায়ন বেশি হতে দেখছেন।
এক সময় সমাজে ভালো ছাত্র ও শিল্পীদের যথেষ্ট কদর ছিল। এখন আর তা দেখা যায় না। ফলে কিশোরদের সামনে কোনো রোল মডেল খুঁজে পায় না। এ ছাড়া কিশোররা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলেও বয়সের কারণে তাদের শাস্তির আওতায় আনা যায় না। তাদের পাঠানো হয় কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে। সেখানে গিয়ে অনেকেই সংশোধিত হওয়া তো দূরের কথা, তারা আরও ভয়ংকর অপরাধী হয়ে বেরিয়ে আসে।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, সন্তানেরা কী করছে? কার সঙ্গে মিশছে, তা জানা যেমন জরুরি; তেমনি সন্তানকে সময় দেওয়াও জরুরি। তার সঙ্গে গল্প করা, তার মনের অবস্থা বোঝা, তার কাছে মা–বাবার অবস্থান তুলে ধরা। সহজ করে বললে, অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানদের বন্ধন তৈরি খুবই জরুরি। এ বন্ধন যত শিথিল হয়, সন্তান তত বাইরের জগতে ছোটে, তখন তাকে ফেরানোর কোনো পথ থাকে না।
সম্প্রতি পুলিশ কিশোর গ্যাংয়ের হালনাগাদ তালিকা তৈরি করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন মতে, দেশে ২৩৭টির মতো কিশোর গ্যাং রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা শহরে (১২৭টি)। এসব গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা ১ হাজার ৩৯২। ঢাকার পর চট্টগ্রামে রয়েছে ৫৭টি। এসব দলের সঙ্গে জড়িত ৩১৬ জন।
কয়েক বছর আগের চেয়ে বর্তমান এই সংখ্যা অনেক বেড়েছে। দেশের বাস্তবতায় কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সংশোধনের সুযোগ রেখে আইন প্রয়োগ, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধকরণ, সামাজিক অনুশাসনের পরিধি বৃদ্ধি এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্র বাড়াতে হবে। পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও বন্ধুবান্ধব কিশোরদের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে পারে। আগে কিশোরেরা প্রকাশ্যে ধূমপান করলে পাড়া বা মহল্লার মুরব্বিরা শাসন করতেন। এখন তাঁরা শাসন করতে ভয় পান। এ ছাড়া সমাজ কাঠামোর দ্রুত পরিবর্তন, নগরায়ণ-শিল্পায়ন, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ও বিশ্বায়নের সঙ্গে অভিভাবকেরা অনেক সময় তাল মেলাতে পারছেন না। সন্তান কী করে সময় কাটায়?
ডিজিটাল ডিভাইসে কী করে, তারা বুঝে উঠতে পারেন না। এ ছাড়া কিশোররা কেন অপরাধে জড়াচ্ছে, তা নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিস্তর গবেষণা হলেও সরকারের বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর তাতে আগ্রহ দেখা যায় না। তাই যুগোপযোাগী আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হলেও সেসব বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে পাড়ায় বা মহল্লায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ রক্ষায় পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়াসহ কিশোর অপরাধ রোধে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের কথা সমাজবিশেষজ্ঞরা বলেন।
লেখক: শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]