রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি থেকে ‘দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স’ হয়ে ওঠার গল্প

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ফাইল ছবি

খুলনার ফুলতলা উপজেলায় দক্ষিণডিহি গ্রামের ‘দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স’ নামটির সঙ্গে আমার জীবনের অনেক কিছু জড়িয়ে আছে। উদ্বোধনের দিনটির কথা আজও মনে আছে, সম্ভবত ১৯৯৫ সালের ঘটনা। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গান করার; যদিও উদ্বোধনের নির্ধারিত প্রথম তারিখটি পরিবর্তন হয়েছিল দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে। এর পর থেকে প্রায় প্রতিবছরের অনুষ্ঠানেই আমি অংশগ্রহণ করেছি এবং গান গেয়েছি। প্রথমে সাধন ঘোষ স্যার এসে আমাদের সব অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিতে তালিম দিতেন। ফুলতলা আসাদ-রফি গ্রন্থাগারে এ আসর জমত। পরবর্তী সময়ে কায়কোবাদ স্যারের বাড়িতে সব অনুষ্ঠানের মহড়া হতো। প্রতিবছর পঁচিশে বৈশাখ ও বাইশে শ্রাবণ অন্তত দুবার তো অনুষ্ঠান হতোই। ২০০৬ বা ২০০৭ সালের পরে নিয়মিত এই অনুষ্ঠানে আর অংশগ্রহণ করা হয়নি আমার পেশাগত ব্যস্ততার কারণে। যদিও এ দিনগুলোয় আমার মন এখনো পড়ে থাকে দক্ষিণডিহিতে। অফিসের কাজের ফাঁকেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই দিনগুলোর কথা।

অবশ্য আমার অনুপস্থিতির আরও একটি কারণ আছে, সেটি হলো আমার বাবা। বাবা ২০০৮ সালে মারা যাওয়ার পরে রবীন্দ্র কমপ্লেক্সের সঙ্গে আমার দূরত্ব একটু বেড়ে যায়, কারণ আমার বাবার জীবনেও এই রবীন্দ্র কমপ্লেক্সের ভূমিকা প্রকটভাবে ছিল। তাঁর অনুপস্থিতির প্রভাবেও খুব বেশি আর যাওয়া হতো না।

আমার জানামতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ির পুনরুদ্ধার এবং এ রবীন্দ্র কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার পেছনে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে আমার বাবাও অন্যতম একজন ছিলেন। আমার মনে আছে, বাবার সাংবাদিক বন্ধু অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনী আমাদের বাড়িতে আসতেন এবং আমাদের দোতলার ঘরে বসেই রচনা হতো অসংখ্য পত্রপত্রিকার লেখালেখি। এই রবীন্দ্র কমপ্লেক্স উদ্বোধনের অনেক আগে থেকেই এগুলো হয়েছে। এরপর খুলনার তৎকালীন ডিসি কাজী রিয়াজুল হক স্যারের উদ্যোগেই চূড়ান্ত কাজটি ১৯৯৫ সালে সম্পন্ন হয়েছিল। এর পর থেকে প্রতিবছর অনুষ্ঠানগুলো আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। আমন্ত্রিত অতিথি হয়েছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য কবি, সাহিত্যিক ও সংগীতশিল্পী। এসেছেন সন্‌জীদা খাতুন, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, পাপিয়া সারওয়ার, সাদি মহম্মদ, মিতা হক, শিবলী মহম্মদ, নীপাসহ অনেক স্বনামধন্য শিল্পী।

পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠা হলো ‘সংগীত নিকেতন’ নামের একটি সংগীত বিদ্যালয়। রবি ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ির ভগ্নাবশেষ ভবনে দ্বিতীয় তলায় এই সংগীত বিদ্যালয়টির ক্লাস হতো। আমিই ছিলাম তার প্রথম শিক্ষার্থী। শুরুতে অধ্যাপক সাধন রঞ্জন ঘোষ স্যার সংগীত আচার্য হিসেবে শুরু করেন, সঙ্গে ছিলে সবুর খান চৌধুরী। উনি আবৃত্তি শেখাতেন। কিছুদিন পরে সাধন স্যারের ব্যস্ততার কারণে তরুণ মজুমদার স্যারই গান শেখাতেন। সার্বিক তত্ত্বাবধান করতেন আবুল বাসার টিটো। খুলনা ডিসি স্যারের দপ্তরের নির্দেশে ফুলতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) তহবিল থেকেই এটি পরিচালিত হতো। যত দূর জানি, স্কুলটি এখন আর চলমান নেই। আমার গান শেখা সেই ভাঙাচোরা ভবনের দ্বিতীয় তলাতেই। এখন ভবনটি অনেক সংস্কার করা হয়েছে। দেখতেও আর আগের মতো লাগে না।

তবে উদ্বোধনপরবর্তী সময়ে দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্সকে নিয়ে অনেক বড় পরিসরে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল। যেখানে শান্তিনিকেতনের আদলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও হওয়ার কথা ছিল। জানি না সে পরিকল্পনা আজও আছে কি না। দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স এখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে দেখাশোনা করা হয়। সরকারের উদ্যোগে রবীন্দ্র কমপ্লেক্স আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, এখানে শান্তিনিকেতনের আদলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার সুযোগ এখনো আছে। বাঙালিত্বে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমরা সব সময়ই এগিয়ে, তারা পারলে আমরা কেন পারব না?

দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স নামটিও আমার বাবার দেওয়া। আমার বাবা পায়গ্রাম কসবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক দেব রঞ্জন সেন। শুরু থেকেই কয়েক বছর দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেব রঞ্জন সেনসহ এ উদ্যোগের পেছনে যাঁদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তাঁদের নাম না বললেই নয়। যেমন দক্ষিণডিহির তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক রাজা, কাজী খেলাফত হোসেন বাচ্চু, বিধান দাশগুপ্ত, অচিন্ত্য কুমার ভৌমিক, লুৎফর রহমান, বরুণ মিত্র, অধ্যাপক কায়কোবাদ, অধ্যাপক মুক্তি মজুমদার, অধ্যাপক সাধন রঞ্জন ঘোষ, অধ্যাপক শফিউল্লাহ, মিনা মিজানুর রহমান, নওরোজ হোসেন, খুলনার তৎকালীন ডিসি কাজী রিয়াজুল হক, তৎকালীন ফুলতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমা সুলতানা, তৎকালীন ফুলতলা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অমিতাভ সরকার। এ ছাড়া আরও অনেকের নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না, তাঁরা ক্ষমা করবেন। আমার মনে হয় পুরোনোদের স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে নতুন উদ্যোগী মানুষেদের আরও ভালো ভালো কাজ করার প্রেরণা জোগাবে।

  • লেখক: কৃষ্ণ সেন, সংগীতশিল্পী ও ফাইন্যান্স অ্যান্ড অ্যাডমিন লিড, সিনজেনটা ফাউন্ডেশন ফর সাসটেইনেবল অ্যাগ্রিকালচার বাংলাদেশ, লালমাটিয়া, ঢাকা।