নিরাপদ যাত্রা ও আনন্দের ঈদ
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানেই উচ্ছ্বাস, ঈদ মানেই বাড়ি ফেরা। ঈদকে কেন্দ্র করে সমাজের প্রায় সব বয়স, শ্রেণি-পেশার মানুষের থাকে নানা আয়োজন। এর মধ্যে অন্যতম আয়োজন হলো ঈদে বাড়ি ফেরা। ঈদের আনন্দ বহুগুণে বেড়ে যায় যখন আমরা বাড়ি ফিরি। অধীর অপেক্ষায় থাকা প্রিয়জনের মুখগুলো দেখি। ঈদ উপলক্ষে নাড়ির টানে পরিবারের সবার সঙ্গে সম্মিলনের জন্য বাংলাদেশের মানুষ কর্মক্ষেত্র বা অস্থায়ী আবাস ছেড়ে পাড়ি জমায় তাদের জন্মভিটায়। কেউ বাসে, কেউ ট্রেনে কিংবা লঞ্চে, কেউ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। যাত্রাপথের ভোগান্তির সঙ্গে যানবাহনের টিকিট পাওয়াও সহজ বিষয় নয়। ফলে যারা বাড়ি ফেরেন, তাঁদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়ে। সঙ্গে সন্তান-সন্ততি থাকলে তো কথাই নেই। ফলে অনেকের কাছেই ঈদে নিরাপদে বাড়ি ফেরার বিষয়টি রীতিমত আতঙ্কে পরিণত হয়। তা সত্ত্বেও মানুষের এই বাড়ি ফেরা থেমে থাকে না।
স্বাধীনতার পর থেকে দেশে নগরায়ন ও শিল্পায়নের বিকাশ ঘটেছে দ্রুতগতিতে। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩১.৬৬ শতাংশ মানুষ নগরে বাস করে। জনবিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৫ শতাংশ নগরে বসবাস করবে। নগরগুলো আজ শিল্পায়নসহ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানাবিধ কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কর্মসংস্থানের আশায় মানুষ নগরে পাড়ি জমায়। সঙ্গত কারণে প্রতি বছর ঈদকে কেন্দ্র করে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী দেশের প্রান্তিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ঈদের ছুটিতে নিরাপদে বাড়িতে ফেরা এদেশের মানুষের কাছে অনেকটা নিয়ম বা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বিষয়টাকে বাড়ি ফেরার সংস্কৃতি বলতে আগ্রহী।
বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ২৩ ভাগ মুসলিম। আর বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯৩ শতাংশ মুসলিম। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো ও ব্যাপক উৎসাহ ও ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে ঈদুল আজহা পালন করে থাকে। এর মধ্যে একটি বিশেষ ঐতিহ্য হলো ঈদে বাড়ি ফেরা। জানা যায় ইন্দোনেশিয়ার বেশিরভাগ মুসলিমই পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঈদ পালন করতে শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমায়। এক তথ্য মতে, এবারের ঈদ উপলক্ষে ইন্দোনেশিয়ার প্রায় ৯ কোটি মানুষ তাদের কর্মস্থল থেকে গ্রামের বাড়িতে যাবে। কর্মের সুযোগসহ অন্যান্য সুবিধাদির কারণে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৬.৮৮ শতাংশ ঢাকা বিভাগে বসবাস করে। ঈদে ঠিক কতসংখ্যক মানুষ ঢাকা ছাড়েন, তার সঠিক কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে কমপক্ষে অর্ধেক নগরবাসী যে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে যান, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ঈদযাত্রার মাত্র ৩–৪ দিনে ১ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার ঢাকা শহর থেকে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাড়ি ফেরেন। সে হিসেবে ঈদ মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বাড়ি ফেরেন। উল্লেখ্য, প্রতিদিন ঢাকা থেকে দেশের সকল জেলায় চলাচলকারী যানবাহনের যাত্রী ধারণক্ষমতা রয়েছে ২২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ বাস-মিনিবাসে, ১ লাখ ৫ হাজার মানুষ রেলগাড়িতে, ১ লাখ ২৫ হাজার লঞ্চে, ৩ লাখ মোটর বাইকে এবং ৩ লাখ ব্যক্তিগত গাড়িতে বাড়ি যান।
জীবন-জীবিকার তাগিদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বসবাসকারী মানুষ বড় বড় শহরে আবাস গড়ে তোলেন। ফলে এসব নগরের অধিকাংশ মানুষের নিজস্ব আবাস থাকে না। তাদের বেশিরভাগ ভাড়া বাসায় থাকেন। তাই ঈদের তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ ছুটিতে তাদের অধিকাংশই চান পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে। সবারই মনের গভীরে বাড়ি বলে যে চিত্রটি আঁকা থাকে, তার অবস্থান কিন্তু মূলত গ্রামে। ঈদ উপলক্ষে সেই বাড়ি বা গ্রামে কয়েক দিনের জন্য হলেও ফিরে যাওয়া, এ যেন নিজেকেই ফিরে পাওয়া। নগর বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঈদ উৎসবে নগরবাসীর গ্রামমুখী হওয়ার নানা কারণ রয়েছে। এখনো ঢাকার ৬০ ভাগ পরিবার প্রধানের জন্ম গ্রামে। আবার যারা ঢাকায় মাইগ্র্যান্ট, তাদের অধিকাংশেরই শহরে নিজস্ব বাড়ি বা ফ্লাট নেই। তাদের পরিবারের একটি অংশ নিজ গ্রামে বা অন্য এলাকায় থাকেন। কেউ কেউ আছেন, যিনি শুধু নিজেই ঢাকায় থাকেন, পরিবার থাকে গ্রামে। এসব কারণে উৎসব আয়োজনে তাঁরা গ্রামে যান।
ঈদ-পার্বণে বাড়ি ছুটে যাওয়া, এটা দেশের মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করার জন্য সবাই বাড়ি ফেরেন। চোখে–মুখে খেলা করে অন্যরকম দ্যুতি! কী সেই অমোঘ টান, যার জন্য মানুষ হাজারো কষ্ট স্বীকার করে বাড়ি ফেরে? যানবাহনে কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই, তবুও কারো মধ্যে যেন এতটুকু বিরক্তি নেই। সবাই নিজে এবং চেনা-অচেনা মানুষদের সঙ্গে ফেরে আপন নিবাসে।
ঈদ কেবল বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবই নয়, আনন্দ-বিনোদন এবং মিলনমেলাও। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করা, কারও বাবা-মার প্রতি টান, কারও পূর্বপুরুষের ফেলে যাওয়া বসতভিটার প্রতি অনুরাগ, কেউ সন্তানকে তার শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দিতে চান। কেউ কেউ চান পরিবার ও আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশি সবার সঙ্গে দেখা ও কুশল বিনিময় করতে। পারিবারিক বন্ধন বা সংহতি বজায় রাখার তাগিদও অনেকের মধ্যে লক্ষ করা যায়। এমন অসংখ্য কারণ নগরবাসীদেরকে তাদের নিজ গ্রামের বাড়িতে টেনে নিয়ে যায়। এই ফিরে যাওয়ায় অনেক সময় প্রেরণা হয়ে থাকে, গ্রামের দিগন্তজোড়া সবুজ মাঠ, খেলার মাঠ, স্কুল বা কলেজ প্রাঙ্গণ, পুকুরপাড়, বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের আড্ডা, সবাই মিলে খেলাধুলা, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটি। যে খালে নাইতো ছোট বেলায়, যে বটগাছটির কাছে গিয়ে আশ্রয় মিলত রোদে-বৃষ্টিতে, সবই মনের মধ্যে কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর গ্রামীণ সমাজও মানুষের ঈদে নগর ছাড়ার অন্যতম কারণ। এখনো দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিনির্ভর। ফলে দেশের নগরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগের শিকড় মূলত গ্রামে। এখনো কারও বাবা-মা, চাচা-চাচি, কারও দাদা-দাদি, নানা-নানি বা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনরা রয়ে গেছে গ্রামে। এক বা দুই প্রজন্মের নগরবাসী হয়েও তারা সেই শিকড় ভুলতে পারেন না। সঙ্গত কারণেই তারা ঈদের আনন্দে ফিরে যেতে চায় সেই শিকড়ের কাছে। যদিও নাগরিক ব্যস্ততা ক্ষণিকের জন্য এসব আবেগ-অনুভূতিকে চাপা দিয়ে রাখে। তবে ছুটির দিনগুলোতে সেই পুরানো স্মৃতিগুলো কাতরাতে থাকে। ফলে অনেক দূরে অবস্থান করলেও, মন চলে যায় স্মৃতির আঙিনায়।
ঈদ পর্বের সঙ্গে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কিছু বিষয় জড়িত থাকে। যেমন অনেকেই ঈদের দিন সকালে ঈদগাহ মাঠে নামাজ আদায়ের পরপরই চলে যান মৃত মা-বাবা বা দাদাদাদি, নানানানির কবর জিয়ারত করতে। জানা যায় প্রাচীনকালে যাযাবর মানুষের স্থায়ী আবাস গঠনে সহায়তা করেছে এই কবর। তাই নগরে অনেকের স্থায়ী আবাস হলেও, অন্তত মা–বাবাসহ অন্যান্য নিকট আত্মীয় স্বজনদের কবরের টানেও তাকে ফিরে যেতে হয়। সারা বছর না গেলেও অন্তত ঈদের ছুটিতে যাওয়ার সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চায় না। ঈদে বাড়ি ফেরার এটিও একটি কারণ।
গ্রামে ফেরার অন্যতম সুফল হচ্ছে গ্রাম-নগরের মেলবন্ধন। স্বল্প সময়ের মেলামেশায় যেটুকু ভাবের আদান-প্রদান ঘটে, তা আত্মিক উন্নয়নে সুদূর প্রসারী প্রভাব রাখে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগব্যবস্থার বিকাশ এমনিতেই নগর ও গ্রামের মধ্যকার দূরত্ব অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে। ঈদ উপলক্ষে বাড়ি ফেরা এ ধারাকে আরও এগিয়ে নিতে পারে। যান্ত্রিকতার এই যুগে ভাইবোনের সন্তান-সন্ততিরা অনেকেই একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে না। ফলে ঈদের সময় বাড়িতে গিয়ে এরা সবাই মিলিত হয়। একে অন্যের সঙ্গে কুশল, মুঠোফোনের নম্বর বিনিময় করে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ওয়াটসআপ, টুইটারে একে অন্যের বন্ধু হয়। এভাবে পরবর্তী প্রজন্মের উভয়ের মধ্যে মেলবন্ধন স্থাপিত হয়।
ইদানীং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদেরকে ঈদের সময় বাড়িতে এসে পুনর্মিলনীর আয়োজন করতে দেখা যায়। অনেক সময় একই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যাচভিত্তিক পুনর্মিলনী চোখে পড়ে। সাধারণত ঈদের পরের দিন এ রকম আয়োজন অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এ ধরনের পুনর্মিলনী ঈদের আনন্দের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ফলে নতুন প্রজন্মের সদস্যরা গ্রামের বাড়িতে আসার এক ধরনের তাগিদ অনুভব করে। ঈদ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সমাজের সব বয়স, পেশা-শ্রেণির মানুষের মধ্যে। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।
* লেখক: খ. ম. রেজাউল করিম, সমাজ গবেষক ও শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর
*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]