পাঠ্যবইয়ের আদ্যোপান্ত: প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ
নতুন বইয়ের প্রতি আমাদের আগ্রহ বরাবরের মতোই অটুট আছে। ঘটা করে উৎসব হয়নি বটে, তবে স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বছরের প্রথম দিনে বুধবার সরকারি বিনা মূল্যের বই বিতরণ করা হয়েছে। আমার কন্যার বইগুলো থেকে ঘ্রাণ শুঁকে নিয়ে নস্টালজিক হলাম। দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ের প্রিন্টিং মান আগের চেয়ে ভালো দেখেছি। ছবিগুলোও ঝকঝকে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ওয়েবসাইট থেকে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সব বইয়ের প্রচ্ছদ, ব্যাক পেজ ও পাঠ্যসূচি দেখে নিলাম। যেভাবে সমালোচনা করা হচ্ছিল, সব বই পাল্টে যাবে, তেমন কিছুই আসলে ঘটেনি। লেখক তালিকা প্রায় অপরিবর্তিত রেখে বেশ কয়েক বছর আগে প্রকাশিত বইগুলোই রাখা হয়েছে শুধু, ক্ষেত্রবিশেষে পরিমার্জন করা হয়েছে। বইগুলোর প্রচ্ছদ এবং ব্যাক পেজ দুর্দান্ত লেগেছে। বিশেষ করে জুলাই বিপ্লবের গ্রাফিতি ও কোটেশনগুলো চমকপ্রদ হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত কোটেশনগুলো বড়রা জানলে বা মানলেও ক্ষতি নেই।
অহংকার পতনের মূল, ’৫২ থেকে ’২৪—ইতিহাস এভাবেই ফিরে আসে। আমি জানি না বলতে শেখাই বড় শিক্ষা (হিব্রু প্রবাদ)। মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি। সৎ পরামর্শের চেয়ে কোনো উপহার অধিক মূল্যবান নয়। সব দায়িত্ব রাষ্ট্রের নয়, কিছু আপনার, কিছু আমার। যে সৎ পথে চলে, সে পথ ভোলে না। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। নারীশিক্ষা ব্যতীত জাতীয় উন্নতি অসম্ভব। সবাই মিলে গড়ে তুলি স্বপ্নের বাংলাদেশ। পরিশ্রম কখনো নিষ্ফল হয় না। বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ। জ্ঞান যেকোনো বন্ধুর চেয়েও উত্তম। এক জাতির দেশ নয়, বহু জাতির বাংলাদেশ। একজন ঘুমন্ত মানুষ আরেকজন ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তুলতে পারে না (শেখ সাদি)। A thing of beauty is a joy for ever. GEN-G, There's nothing we can't do. কারও মনে কষ্ট দিও না। পরিশ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি। ভালো মানুষ ভালো দেশ, স্বর্গভূমি বাংলাদেশ। হাত ধুই সুস্থ থাকি। বল বীর চির উন্নত মম শির। Do not tell a lie. People's Power. বই পড়তে যে ভালোবাসে তার শত্রু কম। যত বিপদ তত ঐক্য। বিদ্যা সজ্জনকে করে বিনয়ী, দুর্জনকে করে অহংকারী। আত্মবিশ্বাস সাফল্যের চাবিকাঠি। দেশকে ভালোবেসে আগলে রেখো। পরনিন্দা ভালো নয়। একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার। পরামর্শ মানসিক শক্তি বাড়ায়। আমরাই বিকল্প। বাবা-মাকে ভক্তি করো। কারার ঐ লৌহ কবাট ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট। মাতব ভাই কখনো দরিদ্র হয় না। এক নতুন ভোরের আলো, আজ খুশির জোয়ার ঢালো। বড়দের সম্মান করো। মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন। প্রভৃতি।
সপ্তম শ্রেণির বাংলা বই ‘সপ্তবর্ণা’র কবিতা অংশে ৯২-৯৩ পৃষ্ঠায় গ্রন্থিত হাসান রোবায়েত রচিত সর্বশেষ নবমতম কবিতা ‘সিঁথি’ পাঠ করলাম।
কবিতাটির পাঠ পরিচিতিতে বলা হয়েছে, হাসান রোবায়েতের ‘সিঁথি’ কবিতায় সাম্প্রতিক বাংলাদেশের এক নির্মম ও মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটেছে। শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থান ২০২৪-এ বিজয়ী হয়ে বাংলাদেশের মানুষ নতুনভাবে মুক্তির স্বাদ পেয়েছে; কিন্তু অগণিত মানুষের আত্মদানের বিনিময়ে রচিত হয়েছে সে মৃত্যুর গাথা। শাসকপক্ষের মরণকামড় উপেক্ষা করে প্রাণ দিয়েছে আবালবৃদ্ধবনিতা। মুখের ভাষার উচ্চারণরীতি আর বাগ্বিধি ব্যবহার করে কবি এক রক্তস্নাত বাংলাদেশের অন্তরঙ্গ ছবি এঁকেছেন। তাতে দেশের কল্যাণ আর মানুষের মুক্তির প্রত্যয়ও ঘোষিত হয়েছে। কবিতাটিতে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪-এর অভ্যুত্থান এক নতুন বিজয়গাথা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জুলাই বিপ্লবকে উপজীব্য করা কবিতাটি কিছু শব্দ ও উপমা বাংলার বাইরে ভিন্ন ভাষার হলেও কবিতার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে তা বাধা প্রদান করে না। বরং নবীন শিক্ষার্থীরা নতুন শব্দবন্ধের সঙ্গে পরিচিত হবে, এটা ভালো।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে গেল পাঁচ মাসে। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা মানতে অস্বীকার করেছেন। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ মুজিববাদের কবর দেওয়া হবে—এমন ঘোষণার কথা বলেছিলেন। অথচ তাঁদের সংঘবদ্ধ এসব কথাবার্তার ছিটেফোঁটাও আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের পরিমার্জিত পাঠ্যবইয়ে দেখলাম না।
নবম ও দশম শ্রেণির বই ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’-এর দ্বিতীয় অধ্যায় ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ (১৪-২২ পৃষ্ঠা) এবং ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’র ত্রয়োদশ চ্যাপ্টারের ‘সত্তরের নির্বাচন ও মুক্তিযুদ্ধ’ (১৬৫-১৮৬ পৃষ্ঠা) শীর্ষক পাঠে একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্বাপর রেখে দেওয়া হয়েছে। এই পাঠগুলো আত্মস্থ করলে যে কেউ বুঝে নেবে বঙ্গবন্ধুকে পাশ কাটিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস এক ভাগও লেখা যাবে না।
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ টপিকসে ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বধীনতার ঘোষণা দেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান এবং ২৭ মার্চ তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে পুনরায় স্বাধীনতার ঘোষণা দেন; এই অংশটুকু নতুন সংযোজন করা হয়েছে।
সেইসাথে ৯৩ হাজার সেনাসহ জেনারেল এ কে নিয়াজি নিঃশর্তে যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন, ওই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার উপস্থিত ছিলেন না—নির্মম ও বাস্তব সত্যটুকু বিবৃত করা হয়েছে।
এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানের ভাষণের বর্ণনা হুবহু রাখা হয়েছে।
বাংলা বইগুলো থেকে জাতির মননশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, আলাওল, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন, সুকুমার রায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, বেগম রোকেয়া, আহসান হাবীব, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, হুমায়ূন আজাদ, আল মাহমুদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আহমদ সফাসহ সবার লেখাই যথাযোগ্য মর্যাদায় রাখা হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-জনতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আলাপের সঙ্গে কারিকুলাম কিংবা পাঠ্যপুস্তক বদলে দেওয়ার নতুন কোনো অভিসন্ধি খুঁজে পাইনি।
ইতিহাস নিজের মতো হয়তো বদলে দেওয়া যায়। সেটা খুব স্বল্প সময়ের জন্য। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস তার স্রষ্টাকে মর্যাদা দিতে ভুল করে না। ইতিহাসে যার জায়গা যেখানে সেখানে তিনিই থাকবেন। আত্মস্বার্থনিমগ্নতার খামখেয়ালি রাজনৈতিক বয়ান দিয়ে ইতিহাস পাল্টে দেওয়া যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকার ঠিক এই ছাপটিই পাঠ্যপুস্তকে রেখেছে। তাদের শাসনপ্রক্রিয়াতেও একইভাবে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ ধারা অব্যাহত রাখবে বলে প্রত্যাশা করি। তাহলেই সুন্দর বাংলাদেশের সুবর্ণ সান্নিধ্য আমরা সবাই পাব।
নাগরিক সংবাদ-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]এ