পর্যটন খাতের যত্ন নিন: সমৃদ্ধির দ্বার উন্মুক্ত রাখার চাবিকাঠি

কাপ্তাই হ্রদে পানি কমে গেলে পর্যটকের প্রধান আকর্ষণ ঝুলন্ত সেতুটি এভাবে জনমানবহীন হয়ে পড়ে থাকে। পর্যটন ঘাট, রাঙামাটি,ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

পাহাড়, নদী, বিল, হাওর, বন, ধর্মীয় স্থান, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত ও ম্যানগ্রোভ—বাংলাদেশ প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের ভান্ডার। দেশের বিচিত্র ভূগোল ও জীববৈচিত্র্য পর্যটকদের মন কাড়ে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও বাংলাদেশের পর্যটন খাতের অগ্রগতি তেমন নেই। দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন খাতে দেশীয় পর্যটকদের আধিপত্য বিস্তার করলেও বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। বাংলাদেশে আগমনকারী বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা যতটা মনে করা হয়, ততটা নয়। ইউএসএইডের মতে, বাংলাদেশে আসা মোট বিদেশির মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ পর্যটন উদ্দেশ্যে আসেন। বাকি ৯৫ শতাংশ বিদেশি গার্মেন্টস শিল্প, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও এনজিওর কাজের সঙ্গে জড়িত। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সূচক-২০২২ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের পর্যটন খাতে ধীরে ধীরে উন্নতি হলেও আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের অবস্থান অনেক নিচে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ভ্রমণ ও পর্যটন উন্নয়ন সূচক-২০২২ মতে, বাংলাদেশের জিডিপিতে ভ্রমণ ও পর্যটন খাতের অবদান ২ দশমিক ২ শতাংশ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান ১ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশের চেয়ে অবকাঠামোগত দিক থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা প্রতিবেশী দেশ নেপালের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৯ শতাংশ।

আমাদের পর্যটন খাত অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তার প্রধান একটি হলো পর্যটন নিয়ে প্রচারের অভাব। দেশের পর্যটন সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী যথেষ্ট প্রচার না হওয়ায় বিদেশি পর্যটকেরা বাংলাদেশকে একটি পর্যটন গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করেন না। এ ছাড়া ভিসাপ্রক্রিয়ার জটিলতা ও বিমানবন্দরে হয়রানি পর্যটকদের জন্য এক বড় বাধা। অন্যদিকে যাতায়াতব্যবস্থা দুর্বল ও খরচ বেশি। বিশেষ করে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের মতো জনপ্রিয় পর্যটন স্থানে যাতায়াত খরচ তুলনামূলক কম হওয়া উচিত। তা ছাড়া অনেক পর্যটন স্পটে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। দূরপাল্লার যাত্রায় বিশ্রাম ও বিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। পর্যটন খাতের বিভিন্ন দিক পরিচালনার জন্য দায়িত্ব একাধিক সংস্থার হাতে থাকায় সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। ফলে পর্যটন খাতের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্য

শুরুর দিকে নিরাপত্তার সমস্যা থাকলেও বর্তমানে তা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের পর্যটন অঞ্চলগুলোয় ‘ট্যুরিস্ট পুলিশ’ নিরাপত্তা সিস্টেমে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে ১০৪টি স্পটে কাজ করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। কক্সবাজার রেঞ্জের অ্যাডিশনাল ডিআইজি আপেল মাহমুদ সম্প্রতি এক কনফারেন্সে জানান, ট্যুরিস্ট পুলিশের সেবায় যুক্ত হলো ‘প্লিজ হেল্প মি’ ইন্টারকম ও ইমার্জেন্সি বাটন সার্ভিস। কক্সবাজারে ঘুরতে গিয়ে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে এই বাটন চাপলে সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকের সেবার উদ্দেশ্যে পৌঁছে যাবে ট্যুরিস্ট পুলিশ। কিন্তু এ দেশে পর্যটনবান্ধব নীতির অভাব, ফলে পর্যটকেরা দেশে এসে নিরাপদ ও স্বচ্ছ পরিবেশ পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে পর্যটন খাতকে আরও বিকশিত করার ওপর জোর দিতে হবে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি উৎস হলো, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প। গার্মেন্টস শিল্পে আসা অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কাঁচামাল আমদানির জন্য বিদেশে চলে যায়। কিন্তু একজন পর্যটকের খরচের বেশির ভাগ অংশ সরাসরি দেশের অভ্যন্তরেই বিনিয়োগ হয়। অর্থাৎ একজন পর্যটক বাংলাদেশে এলে তাঁর খরচের ৮০ শতাংশ হোটেল, খাবার, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতে ব্যয় হয়, যা সরাসরি আমাদের দেশের অর্থনীতিতে যোগ হয়। বাকি ২০ শতাংশ যা তিনি শপিং করেন, তা–ও মূলত বাংলাদেশি পণ্য। অপর দিকে গার্মেন্টস শিল্পে অনেক টাকা এলেও আমাদের সুতা, বোতামসহ অনেক কিছুই বিদেশ থেকে কিনতে হয়। অর্থাৎ গার্মেন্টস থেকে আসা টাকার একটি বড় অংশ আবার বিদেশে চলে যায়। এই তথ্য স্পষ্ট করে দেয় যে পর্যটন খাত আমাদের অর্থনীতিতে অনেক বেশি সুবিধা করতে পারে।

পর্যটন উন্নয়নবিষয়ক এফবিসিসিআইর সভায় দেখা যায়, পর্যটনের সঙ্গে সরাসরি ১০৯টি খাত ও পরোক্ষভাবে ১ হাজার ১০০টি খাত সম্পৃক্ত। পর্যটন শুধু আয় বাড়ায় না, কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করে। প্রতি একজন পর্যটকের কারণে গড়ে ৪৫ জনের কর্মসংস্থান হয় (১০টি প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান ও ৩৫টি পরোক্ষ), যা দেখায় পর্যটন খাত কতটা কর্মসংস্থানমুখী। বর্তমানে বিশ্বে ১০০ কোটির বেশি পর্যটক রয়েছে এবং এই সংখ্যা ২০২৫ সাল নাগাদ ১৬০ কোটিতে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আরও উল্লেখযোগ্য হলো, এই বিপুলসংখ্যক পর্যটকের একটি বড় অংশ, প্রায় ৭৩ শতাংশ এশিয়ায় ভ্রমণ করবেন। ২০৫০ সালের মধ্যে এশিয়া হবে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। এই বিশ্বব্যাপী পর্যটন বাজারের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের জন্য বিশাল সুযোগ তৈরি করেছে। যদি আমরা পর্যটন খাতকে উন্নত করতে পারি এবং পর্যটকদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হই, তাহলে আমাদের দেশের অর্থনীতির চিত্র সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে। তাহলে কেন আমরা এই খাতটিকে আরও গুরুত্বসহকারে দেখছি না? নীতিনির্ধারকদের এই খাতে বিশেষ নজর আরোপ করা উচিত বলে মনে করছি।

পর্যটন শুধু অর্থনীতির একটি খাত নয়, এটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এসডিজির অন্তত ছয়টি লক্ষ্য সরাসরি পর্যটনের সঙ্গে জড়িত এবং বাকিগুলো পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত। অর্থাৎ পর্যটনের বিকাশ না হলে ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে পারব না। দ্রুত পর্যটন খাতের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, পর্যটনকে শিল্পের মর্যাদা প্রদান ও জাতীয় পর্যটন পরিষদের কার্যক্রম বৃদ্ধি করে একটি টেকসই পর্যটন খাত গড়ে তোলার জন্য সরকারি–বেসরকারি খাত ও স্থানীয় সম্প্রদায়কে একযোগে কাজ করতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে পর্যটন শুধু একটি ব্যবসা নয়, এটি একটি দেশের সমৃদ্ধির চাবিকাঠি।

*লেখক: ইসরাত জাহান বুশরা, শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।