বাঁধভাঙা আবেগ আর উচ্ছ্বাসে ভরা এক ফুটবল ম্যাচ

ছবি: সংগৃহীত

আমাদের গ্রামের একটা মেসেঞ্জার গ্রুপ আছে। গ্রুপের নাম ‘প্রিয় জন্মভূমি (বাউশা)’। আমাদের গ্রামের নামেই এ গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। উল্লেখ্য, নেত্রকোনার মদন উপজেলায় আমাদের ‘বাউশা’ গ্রামটি অবস্থিত। গ্রামের অনেক তরুণ–যুবক এই গ্রুপে যুক্ত। ওরা আমাকেও যুক্ত করেছে। গ্রুপের সদস্যরা সবাই নতুন প্রজন্মের। সম্পর্কে ওরা কেউ আমার ভাতিজা, কেউ ভাগনে, আবার কেউবা নাতি। গ্রুপের মাধ্যমে এখন ওদের সঙ্গে আমার নিয়মিতই যোগাযোগ হয়। কাজের ব্যস্ততায় গ্রামে যাওয়া হয় না বললেই চলে। তাই গ্রামের নতুন প্রজন্মের সঙ্গে আমার পরিচয় খুব কম। কিন্তু এই গ্রুপের মাধ্যমে এখন ওদের অনেকের সঙ্গেই আমার পরিচয় হয়ে গেছে। ওদের চিন্তাধারা, গ্রাম নিয়ে ওদের ভাবনা অনেকটাই আমার জানা হয়ে গেছে। বিশেষ করে গ্রাম নিয়ে ওদের অনেক ইতিবাচক চিন্তাধারা দেখে আমি মুগ্ধ হই।

ছবি: সংগৃহীত

এবার পবিত্র ঈদুল আজহার কিছুদিন আগেই গ্রুপে একটা বিষয় নিয়ে জমজমাট আলোচনা শুরু হয়। সেটা হলো ঈদের পরদিন গ্রামের বিবাহিত ও অবিবাহিতদের মধ্যে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে।

ফুটবল ম্যাচটা নিয়ে আলোচনা ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ম্যাচটা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সবাই একমত হয়ে যায়। ওদের ম্যাচটা আয়োজনের উদ্দেশ্য আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। ওদের বক্তব্য হলো, ‘গ্রামে সুস্থ চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা নেই। আছে মাদকের ছোবল। গ্রামের মানুষ, গ্রামের শিশু–কিশোররা তেমন ভালো কিছু দেখে না। গ্রামের মানুষের সামনে, বিশেষ করে গ্রামের শিশু–কিশোরদের সামনে ভালো কিছু তুলে ধরা দরকার। ঈদে সবাই বাড়ি আসবে। সবাইকে নিয়ে একটা ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা গেলে সবাই নির্মল আনন্দ পাবে।’

ছবি: সংগৃহীত

এরপর শুরু হয় এর আনুষঙ্গিক কার্যক্রমের পরিকল্পনা। জার্সি কী রকম হবে, ম্যাচটা কোথায় হবে, ম্যাচটাকে আকর্ষণীয় করার জন্য কী কী করতে হবে—এসব বিষয় নিয়ে গ্রুপে আলোচনা করে তারা। বেশ কিছুদিন গ্রুপে শুধু এই ম্যাচ নিয়েই মাতামাতি। সবাই যে যার মতো সৃজনশীল মতামত দিয়েছে। অনলাইনের সুবিধাটা ওরা সুন্দরভাবে নিয়েছে। ওরা কেউ থাকে ঢাকায়, কেউ থাকে গাজীপুর, কেউ ময়মনসিংহ, কেউবা মদন আর অন্যরা গ্রামে। অনলাইনেই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরপর কেউ জার্সি কিনেছে, কেউ ফুটবল কিনেছে আবার কেউবা ট্রফি কিনেছে। ম্যাচটাকে সুন্দর করতে ওরা কেউ চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি।

ছবি: সংগৃহীত

আমাদের গ্রামে খেলার মাঠ নেই। পাশের গ্রাম পাছ আলমশ্রী ও নোয়াগাঁও—এ দুই গ্রামেই খেলার মাঠ আছে। কিন্তু আমাদের ছেলেরা শেষ পর্যন্ত আমাদের গ্রামের পেছনের ধানখেতে খেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এ ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য হলো, আমাদের গ্রামে খেলাটা হলে গ্রামের ছোট-বড় সবাই খেলাটা দেখতে পারবে আর পরিবেশটাও আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আমাদের এলাকায় খেলাধুলায় ঝগড়াবিবাদ একটা খুব সাধারণ বিষয়। বিভিন্ন সময় এলাকায় আয়োজিত ছোটখাটো টুর্নামেন্টেই সাধারণ বিষয় নিয়ে বড় রকমের ঝগড়াঝাঁটি হয়ে যায়। তাই কোনোমতেই কোনো রকম ঝগড়াবিবাদ যাতে সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারেও তারা গ্রুপে কথা বলে আগেই পরস্পরকে সতর্ক করে রেখেছে।

ছবি: সংগৃহীত

গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের খেলা দেখতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সে জন্য তারা প্যান্ডেলের ব্যবস্থা করে বসার ব্যবস্থা করেছে। এর জন্য প্রয়োজনীয় চেয়ার-টেবিল নিজেরাই বহন করে এনেছে। টেবিলগুলো টেবিলক্লথ দিয়ে সুন্দর করে ঢেকে দিয়েছে। বৃষ্টির কারণে বয়োজ্যেষ্ঠদের যাতে সমস্যা না হয়, সে জন্য ত্রিপালের ব্যবস্থা করেছে। এক কথায় ম্যাচটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করার জন্য সব রকম ব্যবস্থাই নিয়েছে।

মজার বিষয় হলো, তারা যখন যা করেছে, সবই গ্রুপে আপডেট দিয়েছে। ফলে তাদের সব কার্যক্রম খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করা আমার পক্ষে খুব সহজ হয়েছে। তাদের সব আয়োজনই আমি খুব উপভোগ করেছি। আমি কাজ পর্যবেক্ষণ করেছি আর স্মৃতিকাতর হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা কয়েক গ্রামের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা মিলে ‘চেনা কণ্ঠ’ নামের একটা ক্লাব করেছিলাম। এই ক্লাবের মাধ্যমে আমরা এলাকায় খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতাম। ক্লাবটা এলাকায় বেশ সাড়াও জাগিয়েছিল। যাহোক, তখন বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গিয়ে আমাদের খুব কষ্ট হতো। এবারের ঈদে আমাদের গ্রামের ছেলেরাও সে রকম পরিশ্রমটাই করেছে। ওদের সব কাজ পর্যবেক্ষণ করেছি আর আমাদের সময়ের কাজের সঙ্গে মনে মনে মিলিয়েছি। তাই ওদের কষ্টটা আমি খুব ভালোভাবেই অনুভব করতে পেরেছি।

ছবি: সংগৃহীত

এবার ঈদে আগে-পরে বৃষ্টির বেশ ধকল গেছে। বিশেষ করে ঈদের পরদিন, যেদিন খেলাটা হওয়ার কথা, সেদিন সকাল থেকেই অঝর ধারে বৃষ্টি। এমন বৃষ্টিতে বিশ্বকাপ বা আন্তর্জাতিক কোনো টুর্নামেন্টের কোনো ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু আমাদের গ্রামের ছেলেদের দমাবে কে? কাদামাটিতে ফুটবল খেলে তো ওরা অভ্যস্তই। এ ছাড়া এত দিনের আয়োজনকে বৃষ্টির কারণে তো আর ভেস্তে যেতে দেওয়া যায় না। তাই বৃষ্টির মধ্যেই দুই দল যথাসময়ে মাঠে নামে। দুই দলের খেলোয়াড়েরা পাশাপাশি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। প্রত্যক খেলোয়াড়ের সামনে একজন শিশুকে দাঁড় করানো হয় (বিশ্বকাপ ফুটবলের মতো)। শুরু হয় জাতীয় সংগীত। জাতীয় সংগীত গাওয়ার পর শুরু হয় খেলা।

ছবি: সংগৃহীত

অবিবাহিত দলের হয়ে খেলেছে জয়, হারুল, ওলি, রানা (অধিনায়ক), অনীক, রুমান, শুভ, সুলেমান, নাদিম, মাইনুল (ছোট), ইয়াসিন, মাইনুল (বড়), রাফি, জনি, অসীম ও সুমন।

বিবাহিত দলের হয়ে খেলেছে জুনায়েদ, খোকা, বাকি, রাব্বি, রনি, শাহীন, সুমান, টিপু, টিটু (অধিনায়ক), অমিত, সুমন, সানাউল্লাহ, আতিক, আমিনুল ও সম্রাট। যাহোক, পাল্টাপাল্টি আক্রমণের মাধ্যমে উভয় দল জয়ের চেষ্টা করে। উত্তেজনাপূর্ণ এই খেলায় বিবাহিতদের দল জয়ী হয়। তবে শেষ পর্যন্ত জয় হয় ফুটবলের, নির্মল বিনোদনপ্রত্যাশী প্রাণচঞ্চল আর উচ্ছ্বাসে ভরা একদল তরুণ আর যুবকের।

বৃষ্টির কারণে মাঠে আশানুরূপ দর্শক উপস্থিত হয়নি। বৃষ্টিতে ছাতা নিয়ে অথবা ভিজে ভিজে কিছু লোক মাঠে এসে খেলা দেখেছে। তবে গ্রামের মানুষ যার যার বাড়ি থেকে কেউ বা ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, কেউ বা ঘরের জানালা দিয়ে খেলাটা উপভোগ করেছে। অনেকেই আফসোস করেছে মাঠে উপস্থিত হয়ে খেলাটা দেখতে না পারার কারণে।

ছবি: সংগৃহীত

যারা ম্যাচটা খেলেছে, ওরা কেউ পেশাদার ফুটবলার নয়। সবাই এ গ্রামেরই সন্তান। ওদের অনেকেই এ গ্রামেই থাকে। অনেকেই গ্রামের বাইরের দূরের কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কেউবা সরকারি বা বেসরকারি কোনো একটা চাকরি করে। ঈদের ছুটিতে সবাই একত্র হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ফুটবল খেলে নিজেরাও যেমন আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করেছে, গ্রামের মানুষকেও তেমনি নির্মল আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। শুধু খেলা নয়, ঈদে যে কয দিন আছে, ওরা গান, হাসি আর আনন্দে গ্রামটিকে মাতিয়ে রাখছে। ওদের সঙ্গে কথা বলে আমার যেটা মনে হয়েছে, ওরা গ্রামকে অসম্ভব ভালোবাসে, ভালোবাসে এলাকাকে, সর্বোপরি ভালোবাসে দেশটাকে। মাদকের বিরুদ্ধে ওদের অবস্থান। এলাকার দলাদলি, হানাহানিকে ওরা ঘৃণা করে। ওরা চায় পুরো গ্রামে, পুরো এলাকায় শান্তি বিরাজ করুক, পুরো এলাকার মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারুক আর শান্তিতে ভরে উঠুক পুরো দেশ। প্রীতি ফুটবল ম্যাচটার মাধ্যমে ওরা এ বার্তাই পৌঁছে দিতে চেয়েছে। ওদের চিন্তাধারা আমাকেও আশাবাদী করেছে। হয়তো একদিন আমার গ্রাম, আমার এলাকা আর আমার দেশটা শান্তি আর শান্তিতে ভরে উঠবে। এমন একটা সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় রইলাম।

  • লেখক: মো. মোতাহার হোসেন, প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত), মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা