মা

মা
ফাইল ছবি

মায়ের ভালোবাসায় কোনো ভেজাল নেই। নেই কোনো স্বার্থের লেশমাত্র। মা–বাবা সন্তানকে ভালোবাসে নিঃস্বার্থভাবে। সন্তান গর্ভধারণ থেকে শুরু করে তাকে সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। মা কখনো সন্তানকে ফেলে যেতে পারেন না। সন্তানের সামান্য কষ্টতেও মা অস্থির হয়ে ওঠেন। সন্তান যেন ভালো থাকে, এটাই তাঁর চাওয়া। আমার ছোটবেলায় আব্বু মারা যান। আমি তখন খুব ছোট। আমরা চার ভাইবোন।

বাবার মৃত্যুর পর আম্মু নিজেই নেমে পড়েন বাবার ভূমিকায়। অনেক ঝড়-তুফান এলেও মা আমাদের সব সময় আগলে রেখেছেন। নিজে না খেয়ে খাইয়েছেন আমাদের। আমাদের পড়াশোনা যেন কখনো বাধা না পড়ে, সে জন্য তাঁর ছিল কঠোর পরিশ্রম। নিজে পরিশ্রম করেছেন, ক্লিনিকে কাজ করেছেন, মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাঁস-মুরগিকে টিকাসহ নানান কাজ করে সংসারের হাল ধরেছেন শক্ত হাতে। আমাদের কখনো কাজে পাঠাননি। বরং আমি যখন অনার্সে পড়ি, তখন প্রায়ই আম্মা বলতেন, ‘বাবা, ভালো করে পড়, পড়াশোনার খরচের কথা চিন্তা করা লাগবে না।’ তিনি এভাবেই প্রতিনিয়ত দিয়ে যেতেন উৎসাহ। এমনকি টিউশনি করলে পড়ায় ব্যাঘাত ঘটবে কিংবা পরীক্ষায় ফল খারাপ হবে, তাই টিউশনি করতেও ‘না’ বলতেন তিনি।

অনেকেই বাড়ি গেলে বলেন, তোর আম্মা তোদের জন্য যা করেছেন, একটা পুরুষও তা পারে না। আসলেই, আমার মা সেরা মা। আমাদের পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সব সময় যত্নবান। যখন যে বইটা কিনতে চেয়েছি, কষ্ট করে হলেও কিনে দিয়েছেন। এসএসসি পরীক্ষা শেষে আম্মুকে বলেছিলাম, আম্মু, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে চাই। আম্মা টাকার কথা জিজ্ঞেস করলেন না। বললেন, তাড়াতাড়ি ভর্তি হয়ে যাও, সময় নষ্ট কোরো না। ভর্তি হয়ে গেলাম। পড়াশোনা শুরু হয়ে গেল। আম্মুর মুখে যেন হাসি ফোটাতে পারি, এ টার্গেট নিয়েই বসলাম পড়ার টেবিলে। অবশেষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আসন পেয়ে যাই। আমার চান্স হওয়ার খবর শুনে আম্মু কী যে খুশি হয়েছিলেন, তা ভাষায় বুঝিয়ে বলতে পারব না।

আমি আম্মুকে ফলাফলের কথা বলতে গিয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলাম। আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, কান্না করছিস কেন? আমি বললাম, আম্মা, আমার চান্স হয়েছে। আম্মুর পাশে হয়তো কেউ ছিল। আম্মাকে পাশের কাউকে বলতে শুনেছিলাম, আমার বাবার বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়েছে। তাঁর সে কী যে আনন্দ, উচ্ছ্বাস! সে মুহূর্তের কথা আমি কোনো দিনও ভুলব না।

রাতে যদি কোনো দিন না খেয়ে ঘুমাতে গিয়েছি, আম্মা বলতেন, রাতে না খেয়ে ঘুমালে বল কমে যাবে। আমার সোনা, আমার লক্ষ্মী বলে উঠিয়ে ভাত খাইয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। কোনো জায়গায় কিছু খেতে দিলে নিয়ে আসতেন আমাদের জন্য। ছোটবেলায় দেখছি, আম্মু সারা দিন কাজ করে সন্ধ্যায় বাড়ি এসেও হারিকেন প্রস্তুত করে আমাদের নিয়ে বসতেন। পড়াশোনা ব্যাপারে তিনি কোনো ছাড় দিতেন না। আম্মার একটা কথা আমার এখনো মনে আছে। পড়ায় মনোযোগ না দিলে তিনি বলতেন, ‘আজ আমার যে কাজ, কালও আমার সে কাজ।’

একদিন পড়ব, অন্যদিন ফাঁকি দেব, এটা তিনি মোটেও পছন্দ করতেন না। আমরা কোথাও গেলে আম্মা খুব চিন্তিত হয়ে পড়তেন। এখনো আম্মার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। এই ঈদে লঞ্চে করে বাসায় গিয়েছিলাম। আম্মা সাহ্‌রি খেয়ে আর ঘুমাননি, কখন আমি বাড়ি ফিরব, সেদিকে চেয়ে বসে আছেন। আমি যখন গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আম্মা বললাম। তিনি প্রথম ডাকেই সাড়া দিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, আম্মা, আপনি ঘুমাননি? বললেন, বাবা, তুই কখন আসবি, সেই অপেক্ষায় বসে আছি, সাহ্‌রি খেয়ে আর ঘুমাইনি। আসলে মায়ের ভালোবাসার ক্ষয় নেই। তাঁর ভালোবাসা অক্ষয়, অমর ও নিঃস্বার্থ।

সবাই ছেড়ে গেলেও মা–বাবা সন্তানকে ছেড়ে যায় না। আজ অনেকে বিভিন্ন প্রয়োজনে কাছে এলেও প্রয়োজন পুরিয়ে গেলে অনেকে চলে যায়। যত দিন আমাকে তাদের প্রয়োজন, তত দিনই তাদের ভালোবাসা। কিন্তু মায়ের ভালোবাসা অকৃত্রিম। তিনি সব সময় সন্তানের পাশে থাকেন ছায়ার মতো। বাবা বটবৃক্ষ। দুঃখের বিষয় হলো, অনেকেই বউ ঘরে এলে ভুলে যান মা–বাবাকে। তাঁদের সঙ্গে অসদাচরণ করেন। মা–বাবা যে ঘরে আছেন, সে ঘরের মতো সুখী কে আছে। আসুন, মা–বাবাকে ভালোবাসি। তাঁদের সঙ্গে সদাচরণ করি। তাঁদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করি।

লেখক: মারুফ হোসেন, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়