তারাও পাক শিক্ষায় সমান ভাগ

ছবি: আনিস মাহমুদ

চা–পান করতে করতে বৃষ্টি দেখে কাব্যিক মন। চায়ের সঙ্গে মিটিং চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পড়তে বসার আগে চাই এক কাপ চা। মাথাব্যথা সারাতেও চায়ের জুড়ি মেলা ভার। সন্ধ্যার আড্ডা জমে না চা–বিহীন। সুন্দর সকালের শুরুতে চাই এক কাপ চা। বিরক্তিকর অবসরে চা হয় একমাত্র সঙ্গী। এককথায়, চা হচ্ছে নিত্যসঙ্গী অবসরে, আড্ডায়, নিঃসঙ্গতায়। তাই শৌখিন পানীয়ও বলা যায় একে। শখের তোলার যেহেতু আশি টাকা দর, তাই চায়ের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম একেবারেই নয়।

আমরা চা পানে যেমন চাঙা হই, তেমনি চা–বাগান দেখেও হই বিমোহিত। ছুটি কাটাতে চলে যাই চায়ের রাজ্যে। হারিয়ে যাই সবুজের দেশে। পাহাড়ের পর পাহাড় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে সবুজ পাতার আবরণে। সেই মনোরম দৃশ্যে অভিভূত হই ক্ষণে ক্ষণে। ঋতুভেদে কচিপাতা তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন চা–শ্রমিকেরা। পিঠে ঝুড়ি ঝুলিয়ে খুঁটে খুঁটে নাটকীয় ভঙ্গিমায় পাতা ছিঁড়ে ঝুড়ি ভরতে থাকেন বাগানিরা। সেই দৃশ্য দেখেও মন পোড়ে। ‘আহা! যদি হতে পারতাম পাহাড়িদের একজনা, যদি গড়তে পারতাম এই সবুজে একখানা বাঁশের ঘর, তবেই না নিয়ম করে তুলতাম কচিপাতা। আহা সে কী জীবন!’ শহুরে মানব মন এভাবেই ডুকরে ওঠে সবুজের সান্নিধ্যে এসে। অথচ এই সুবজের আনাচকানাচে খেলা করে বিষণ্নতা। সে খবর কয়জনই–বা জানে, যদি জানত, তবে এমন ইচ্ছা পোষণের আগে ভেবে নিত বহুবার।

প্রথম আলো বন্ধুসভা গত বছরের মতো এবার ভালো কাজে উঠে পড়ে লেগেছে। সারা দেশের শতাধিক বন্ধুসভায় চলছে হরদম ভালো কাজ। বসছে মিটিং, হচ্ছে আলোচনা, বেরিয়ে আসছে নানা ধরণের কাজের পরিকল্পনা। গৃহীত হচ্ছে নানাবিধ সিদ্ধান্ত, চূড়ান্ত হচ্ছে ভালো কাজ কোনোটা করা যায়, সেটা।

সিলেট বন্ধুসভাও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই অনেক আলাপ–আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো চা–শ্রমিকদের নিয়েই ভালো কাজ হবে। যেহেতু কিছুদিন আগে বেশ সরগরম ছিলেন চা–শ্রমিকেরা তাঁদের অধিকার আদায় নিয়ে। তাই প্রথম ধাপে ভালো কাজের আগেই একবার দেখতে গেলাম তাদের অবস্থা। দেখে আসার পর সিদ্ধান্ত হলো, যা–ই করি, তাঁদের ঘিরেই হবে কাজ। যে কথা সে কাজ।

শখের চায়ের দামের তোলা অনেক হলেও সেই চা যাঁদের হাত ধরে পৌঁছে যায় পৃথিবীর আনাচকানাচে, সেই মানুষগুলোর পরিবার চলে বেশ টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে। পড়াশোনা এখানে বিলাসিতার কাজ। চা–শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য তৈরি বিদ্যালয়ে বৃত্তি বা ভাতার নেই সুব্যবস্থা। শ্রেণির প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান অধিকারীরা অতি সামান্য পরিমাণ বৃত্তি পায় বছরে একবারই, যা দিয়ে এক মাসের খাতা–কলমের জোগান দেওয়াও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এমন দুরাবস্থা দেখে আমরা চা–শ্রমিক পরিবারের সন্তানদের হাতে তুলে দিই খাতা–কলম, রংপেনসিল। ছোট দুই কক্ষবিশিষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে একটি হোয়াইট বোর্ডসহ মার্কার, ডাস্টারসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী উপহারস্বরূপ দিই।

ভালো কাজে সিলেটের বন্ধুসভার সভাপতি হুমাইরা জাকিয়া পুতুল, সাধারণ সম্পাদক অন্তর শ্যাম, অর্থ সম্পাদক সমীর বৈষ্ণব, ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য সম্পাদক দ্বীপান্বিতা, অনুষ্ঠান সম্পাদক ফারিয়া খানম, মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক শ্রেয়ান ঘোষ, পরিবেশ ও দুর্যোগ সম্পাদক সৈয়দ সালমান হাসান, সদস্যদের মধ্যে ফারহানা হক, মিফতা হাসান, আশরাফুল ইসলাম, ফয়সাল আহমেদ, আব্দুল মুহাইমিনসহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বেলা শেষে ভালো কাজ করতে পেরে আমাদের মন প্রফুল্ল চিত্তে ঘরে ফেরে। জীবন এক গোলকধাঁধা। এখানে কেউ হাসে, কেউ কাঁদে। দিন শেষে সবাই এক। মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়ায়। একরাশি নির্ভরতায় বাড়িয়ে দেওয়া হাত হোঁচট খেয়ে গুমরে পড়ে থাকা মানুষের ঠোঁটের কোণে ভরসার হাসি ফোটাতে পারে। আশ্বাস জানাতে পারে—তুমিও পারবে উঠে দাঁড়াতে, আপাতত আমার হাতই হোক উঠে দাঁড়ানোর উৎস। সারা দেশে ১৩০টি বন্ধুসভা ভালো কাজ করছে যার যার জায়গা থেকে। এত এত ভালো কাজ হাসি ফোটাচ্ছে এমনও অনেক হৃদয়ে, যে হৃদয় হাসি ভুলে গিয়েছিল অনেক কাল আগে। আমার গর্ব হয় আমি এ বন্ধুসভার একজন, এই প্রথম আলোর কাছাকাছি একটা মানুষ, যারা নিত্যনতুন ফন্দিতে দেশের কোনায় কোনায় পৌঁছে যাচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি হয়ে অসহায়ের পাশে।

লেখাক: হুমাইরা জাকিয়া পুতুল, সভাপতি, সিলেট বন্ধুসভা