‘সুন্দরী তার ডাকনাম’
‘আজ সকালে তুমি কত্ত সুন্দর করে সেজেছিলে, দেখতে খুবই খুবই সুন্দর লাগছিল তোমাকে। যেন হঠাৎ কোথা থেকে নেমে এসেছিল পরী। ঠিক পরী কি? নাকি কোনো মহারানি? জানি না, কোন শব্দবন্ধে তোমাকে আবদ্ধ করলে ওই সৌন্দর্যের প্রতি সুবিচার করা হবে’, বলে তার প্রিয় মানুষটির প্রশংসা করে যাচ্ছিল সিহাব। তার প্রিয় মানুষটা প্রতি উত্তরে আক্ষেপ করে জানিয়েছিল, ‘আমাকে নিয়ে একটা কবিতা লেখার কথা বলেছিলাম। তুমি সেই কথা রাখোনি।’
সিহাব যে তার প্রিয়তমা, ‘সুন্দরী’ যার ডাকনাম—তাকে নিয়ে কবিতা লেখেনি তা নয়; একটা কবিতা লিখেছিল মনঃকষ্টে ভুগে। কিন্তু সেই কবিতা তার সুন্দরীর কাছে মনে হয়েছিল অবমাননাকর। সুন্দরী ভেবেছিল, তাকে অবমাননা করেই এই কবিতা লেখা হয়েছে। সিহাব জানে, ভালোবাসায় কখনো অবমাননা থাকে না। থাকে অভিমান। সেই অভিমানগুলো শব্দে শব্দে সাজিয়ে লাইনগুলো হয়ে উঠে কবিতা। সেই কবিতা সে উৎসর্গ করে তার সুন্দরীকে। কিন্তু সুন্দরীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার কবিতা না লেখাটা তাকেও কিছুটা মনোবেদনায় ভুগিয়েছিল। কিন্তু সিহাব তো হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো প্রেমিক নয়। সে জানে, কীভাবে তার সুন্দরীকে সে সন্তুষ্ট করবে।
তারপর সে কবিতা লিখেছিল তার নামে—
‘সুন্দর সকালে তোমাকে দেখে
ছড়িয়ে গেল মুগ্ধতা
তোমায় এত ভালো লাগার পিছে
আছে কোন মন্ত্রটা?’
এরপর শুরু হয় সিহাবের কবিতা লেখার যাত্রা। আর প্রতিটা কবিতা উৎসর্গ হয় সুন্দরীর নামে। কবিতার প্রতিটা শব্দে, প্রতিটা লাইনে থাকে তার ছাপ। দিন শেষে সেই কবিতাগুলো আবৃত্তি করে শোনানোই সিহাবের নিয়মিত রুটিনে পরিণত হয়। সুন্দরীকে নিয়ে শব্দ সাজিয়ে কবিতা লেখার মধ্যেই সব সুখের রসদ খুঁজে পায় সে। আর সেই কবিতা আবৃত্তি করে শোনানোতে বাকি মাত্রা যোগ হয়। তার সুন্দরীও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তাকে নিয়ে লেখা কবিতা শুনে যায় নির্মোহ দৃষ্টিতে। সিহাব তখন ভাবে, এই মুহূর্ত দেখেই সে কাটিয়ে দিতে পারবে এক কোটি বছর। সুন্দরীর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের পাতা না ফেলেই চলে যাবে সময়।
সিহাব শুধু তার সুন্দরীকে নিয়ে কবিতাই লেখে না। লাইনের পর লাইন লিখে যায় তাকে নিয়ে অবধারিতভাবে, সাজায় অনুভূতির পসরা। লাইনের পর লাইন যায়, শব্দের পর শব্দ বসে; কিন্তু সুন্দরীকে নিয়ে লেখা থামে না। দিন নেই, রাত নেই তাকে নিয়েই শব্দ সাজিয়ে যায় সিহাব প্রবল উৎসাহে। কারও প্রতি তীব্র অনুভূতি ছাড়া এভাবে লিখে যাওয়া সম্ভব নয়। সিহাব তখন অনুভব করে, সুন্দরী তার হৃদয়ে কতটা স্থানজুড়ে বসবাস করছে। এই সত্য সুন্দরীও কখনো অস্বীকার করে না। সে-ও জানে, এভাবে তাকে কেউ কখনো ভালোবাসার অনুভূতি জাগাতে পারেনি, যতটা জাগিয়েছে সিহাব। তাই সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকে এই অনুভূতির মাত্রা।
সিহাবের জীবনে সুন্দরীর আবির্ভাব বেশ আচমকাই হয়েছিল। তার সঙ্গে এত নাটকীয়ভাবে পরিচয় হবে, সেটা ভাবতেও পারেনি সে। তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার নাটকীয় ঘটনা অবলম্বনে একটা সমৃদ্ধ নাটক লিখে ফেলাও সম্ভব বলে ভাবে সে। নাটকের চরিত্রে তারা না থাকলেও, বাস্তবে যে তারাই এই নাটকের প্রধান কুশীলব।
সুন্দরীর সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে সিহাব তাকে ওভাবে ভাবতে শেখেনি তখনো। আর এই ভাবতে শিখতে না পারাটাই হয়তো সুন্দরীর বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সিহাব তখন এতটাও বুঝতে শেখেনি সুন্দরীকে। তাই সুন্দরীর মনের ভাষাও তাঁর কাছে অধরা থেকে গেছে। সে এজন্য এখনো মনে মনে দুঃখপ্রকাশ করে। আর ভাবে, সে কেন এমনটা করেছিল! কিন্তু তারও পেছনের অনেক গল্প থাকে, যে গল্পগুলো মানুষ জানতে পারে না।
মানুষের সঙ্গে সহজে মিশতে পারা যায়, কিন্তু মিশে যাওয়ার পর আর তাকে অত সহজে ছাড়তে পারা যায় না বলেই জানে সিহাব। সে জানে না, কারও এমন হয় কি না। কিন্তু তার এমনটা হয়। কারও সঙ্গে মিশে গেলে অল্পতে, তাকে আর ছাড়তে পারে না সে। ইংরেজিতে যাকে বলে প্রবলেম অব অ্যাটাচমেন্ট। তার এই অ্যাটাচমেন্টের সমস্যা আছে। তাই কারও সঙ্গে সহজে মিশে যাওয়ার আগে তাকে অনেক কাঠখোট্টা পার হতে হয়। সুন্দরীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল বলে স্বীকার করে সিহাব। সিহাবের নিজেরও অতীত আছে। সেই অতীত সুখকর ছিল না। ফলে কারও সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের জালে জড়ানোর মতো মানসিক অবস্থাও তার ছিল না। মানুষের সঙ্গে যতটুকু দূরত্ব রেখে কথা বলা যায় শ্রদ্ধা রেখে, ততটুকু বলার চেষ্টা করত সে। সুন্দরীর সঙ্গেও ঠিক তেমনটাই তার করতে হয়েছে।
ধীরে ধীরে যখন সিহাব আর সুন্দরীর কথা বলার মাত্রা, ধাঁচ বদলাতে থাকল; তখন সিহাব আর নিজেকে নিজের মধ্যে রাখতে পারেনি। সুন্দরীর অকপটতা, তার নিবেদন তাকে বাধ্য করেছে নিজের খোলস থেকে বের হয়ে এসে সুন্দরীর মতো করে ভাবতে। সিহাব ভাবতে শুরু করে সুন্দরীর চিন্তায়, যেমনটা সে চেয়েছিল। তারপর তাদের কতশত স্মৃতিময় মুহূর্ত কেটেছে, তারা কেউই এর হিসাব রাখতে পারেনি। এই স্মৃতিগুলো আসলে হিসাব করে রাখা যায় না। সুন্দরী পরিণত হয় তার নিয়মে।
সুন্দরীর সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত সিহাবের জন্য সুখস্মৃতি। যে স্মৃতিগুলো সে সব সময় বন্দী করে স্মৃতির পাতায় আবদ্ধ রাখতে চেয়েছে। সিহাবের পাগলামির মাত্রা বোঝা যায়, এই কথা শোনার পর যে তাদের প্রথম দেখায় যে প্যাকেট, খোসা, পলিথিন, টিস্যু ছিল—সব সে সংরক্ষণ করে রেখে দিয়েছে। এসব কেউ স্মৃতি হিসেবে রেখে দেয়? কিন্তু সিহাব রেখে দিয়েছে। এখন যে কেউ এই কার্যকলাপের জন্য তাকে পাগল অভিধায় সিক্ত করতে পারে। কিন্তু তাতে সিহাবের কিছুই যায়–আসে না।
সিহাবের মনে হয়, তার প্রিয়তমা সুন্দরীর সঙ্গে কাটানো স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো চিরদিন মনে রাখার মতো। কিন্তু মনে রাখার মতো সময় সে পাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন করে নিজেকে। কারণ, তাদের সম্পর্কের মধ্যেও কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে।
সিহাব মিশতে মিশতে সুন্দরীর সঙ্গে কতটা মিশে গিয়েছে, তা হয়তো ভাবাতীত। কিন্তু সে যা করেছে, তার একটাও মিথ্যা নয়। যা করেছে, মন থেকেই করেছে। এত কিছুর পরও দুঃখকষ্টে সঙ্গে থেকেছে। যতটুকু পেরেছে, সুন্দরীকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করেছে সর্বোচ্চ ভালোবাসার। তার এই ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষাটা অন্য রকম। কাউকে দেওয়ার মতো সিহাবের কিছু না থাকলেও, কিন্তু তার একটা লোভ আছে—অমরত্ব পাওয়ার লোভ। সে ভাবে, কারও কাছে অমর হয়ে থাকতে চাইলে তার কাছে একমাত্র ভালোবাসা ছাড়া দেওয়ার মতো কিছু নেই। সে জন্য সে যদি কাউকে ভালোবাসার সুযোগ পায়, নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে ভালোবাসে। কিন্তু এই সর্বোচ্চ ভালোবাসা দেওয়ার পরিণতি কী হয়, তা জেনেও সে বারবার এই কাজ করে গেছে।
একটা সময় পর এসে সিহাবের মনে হয়, সুন্দরীর কাছে কথা বলার জন্য তাকে আরজি করতে হচ্ছে। কতটা শূন্যতা অনুভব করলে একটা মানুষকে কতটা মনে করলে এই অনুভূতি আসে, সুন্দরী তা বোঝে না বলেই সিহাবের অভিমানের অন্ত নেই। সিহাব তখন নিজেকে পাগল বলেই ঘোষণা করে। সে নিজের মধ্যে থাকতে পারে না। এই থাকতে না পারা, সুন্দরী তার অনুভূতিকে বুঝতে অক্ষম হওয়ায় সে অভিমানে কাতর হয়ে যায়। সিহাব নতজানু হয়ে শুধু একটু তারই সান্নিধ্য চায়। এই অনুভূতি বুঝতে না পারাই তাকে অসহায় করে দিন দিন। এর দায় সে কাউকে দিতে নারাজ। এর দায় সে নিজের কাঁধে তুলে নেয়, দায় নেয় তার অনুভূতি সুন্দরীকে বোঝাতে ব্যর্থ হওয়ার।
দিন যায় ব্যস্ততা বাড়ে সুন্দরীর, তার সঙ্গে বাড়ে মৃদু উপেক্ষাও। এর সবকিছুই সিহাবের চেতনাকে বিপর্যস্ত করে গভীর থেকে। সে মানতে পারে না, ঠিক আগের মতো করে তারা দুজন আর উচ্চ হাস্যে মেতে উঠতে পারবে না। এই কথা মনে হলেই, সুন্দরীর হাসির শব্দ কানে বাজে তার।
সে বোঝে, কাউকে মায়ার বাঁধনে জোর করে আটকানো যায় না। নিয়ম মেনেই নিজেকে অনিয়মের আস্তাকুঁড়ে ফেলে হলেও প্রিয় মানুষদের চলে যাওয়া দেখতে হয়। কিন্তু এই চলে যাওয়া কতটা প্রভাব রেখে যায়, তা আর প্রকাশযোগ্য থাকে না। সিহাব তো কম চেষ্টা করেনি! সে কাউকে তা বলতেও পারে না। সে নীরবে নিভৃতে জীবনযাপন করতে থাকে অস্বাভাবিক নিয়মে। কারণ তার নিয়ম বলে শুধু সুন্দরীই ছিল। সে আজ দূরে, বহুদূরে।
*লেখক: শাহরিয়ার সিফাত, শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।