নগর–পরিকল্পনা: বাংলাদেশে নতুন দৃষ্টিকোণ

ঢাকা শহরফাইল ছবি

কখনো কি ভেবেছেন, আমাদের শহরগুলো কীভাবে এত দ্রুত বাড়ছে? মানুষ, যানবাহন, ভবন—সবকিছুই যেন একে অপরকে টেনে নিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের শহরগুলো আজ এমন একটি স্তরে পৌঁছেছে, যেখানে প্রতিটি উন্নয়ন সিদ্ধান্ত আগামী প্রজন্মের জন্য চিহ্ন রেখে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ দ্রুত পরিবর্তনে নগর–পরিকল্পনাকারীরা কেমন পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করছেন? ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের শহরগুলোর জনসংখ্যা ৭৫ শতাংশে পৌঁছানোর পূর্বাভাস রয়েছে এবং এমন বাস্তবতায় নগর–পরিকল্পনাকারীদের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলো যেন কোনোভাবেই শেষ হচ্ছে না।

নগর–পরিকল্পনাকারীরা দেশের অবকাঠামো, পরিবহনব্যবস্থা ও নগরের পরিবেশগত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে দায়িত্ব পালন করছেন, কিন্তু এ প্রক্রিয়া একেবারেই সহজ নয়। বাংলাদেশে নগর–পরিকল্পনাকারীদের জন্য বাজেটের অভাব একটি বড় সমস্যা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার শহর উন্নয়নের জন্য মোট এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে, কিন্তু শহরগুলোর দ্রুত বর্ধনশীল চাহিদা মেটানোর জন্য এই পরিমাণ অর্থ অপ্রতুল। ঢাকা শহরের মতো বৃহত্তম শহরেও নগর–পরিকল্পনা কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেটের ৫০ শতাংশের কম বরাদ্দ রয়েছে। এর ফলে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, যেমন পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অথবা দেরি হচ্ছে। শহরের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য যে বাজেট প্রয়োজন, তা অনেক সময় বরাদ্দের সীমা ছাড়িয়ে যায়, ফলে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি হয়।

শহর উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক প্রকল্প নেওয়া হলেও এগুলোর কার্যকরী বাস্তবায়ন প্রায়ই অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ব্যাহত হয়। ২০২১ সালে বাংলাদেশে শহরগুলোর জন্য ৩৮টি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল, তবে এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ প্রকল্পে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। এতে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন সময়ে অতিরিক্ত বিলম্ব ঘটে, যা শহরের সার্বিক উন্নয়নকে ব্যাহত করে। অনেক প্রকল্প যেখানে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেগুলো যথাযথভাবে একত্রে বাস্তবায়ন হতে পারেনি।

শহরের ভূমি অধিকার নিয়ে বড় ধরনের জটিলতা রয়েছে। ঢাকা শহরের ভূমি বাজারে এককভাবে অবৈধ দখলের পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশ বলে মনে করা হয়। ২০২১ সালে ভূমি প্রশাসন ও নগর–পরিকল্পনা বিভাগের সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকা শহরের ৫২ শতাংশ এলাকায় অবৈধ দখল ও পরিকল্পনাহীন নির্মাণ কার্যক্রম চলছে। এভাবে অবৈধ দখল ও আইনগত জটিলতা নগর–পরিকল্পনাকারীদের জন্য এক বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যার কারণে অনেক প্রকল্পের উন্নয়ন বা উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন অচল হয়ে পড়েছে।

নগর–পরিকল্পনার কার্যকরী বাস্তবায়নের জন্য জনসচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২২ সালে সরকারের একটি জরিপে দেখা গেছে যে ঢাকার প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ সড়ক পরিবহনব্যবস্থায় ব্যর্থতা ও অব্যবস্থাপনার জন্য সঠিকভাবে চলাচল করতে পারে না। সড়ক আইন মেনে চলার অভাব, অবৈধ পার্কিং ও ফুটপাত দখল করার কারণে শহরগুলোর উন্নয়ন পরিকল্পনা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এতে নগর–পরিকল্পনাকারীদের জন্য আরও একটি বড় বাধা সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশে নগর–পরিকল্পনার জন্য অত্যন্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাব রয়েছে। বর্তমানে দেশের মোট নগর–পরিকল্পনাকারীর সংখ্যা চার হাজারের কিছু বেশি, যা মোট শহরের সংখ্যা ও জনসংখ্যার চাহিদার তুলনায় কম। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে নগর–পরিকল্পনা বিভাগের অধীনে কর্মরত পেশাজীবীদের মধ্যে ৩৫ শতাংশেরই নগর–পরিকল্পনার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা ছিল না। এটি শহরের উন্নয়ন কার্যক্রমের গুণগত মান কমিয়ে দেয় এবং সমস্যার সৃষ্টি করে। শহরের জন্য পরিকল্পনাকারীদের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। কারণ, তাঁদের কাজ শহরের সার্বিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে।

বাংলাদেশের শহরগুলের উন্নয়ন সম্ভবত অপ্রতিরোধ্য, তবে এর জন্য নগর–পরিকল্পনাকারীদের সমস্যাগুলো সমাধান করা অত্যন্ত জরুরি। সরকারের পক্ষ থেকে বাজেটের বরাদ্দ বৃদ্ধি, আইনি জটিলতা দূরীকরণ ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নগর–পরিকল্পনাকারীদের কাজকে আরও কার্যকরী করা সম্ভব। এ ছাড়া দক্ষ কর্মী বাহিনী ও উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শহরের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সহজ হবে এবং এটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

*লেখা: ত্বসিন আবরার নাহিন, স্নাতকোত্তর ছাত্র, নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)