শিক্ষক নির্যাতন, অমানিশার অন্ধকার

চুয়াডাঙ্গা ভিক্টোরিয়া জুবিলি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষককে মারপিটের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রের শাস্তির দাবিতে সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি। আজ দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

চুয়াডাঙ্গায় সহকারী শিক্ষক (বাংলা) হাফিজুর রহমানের ওপর তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র কর্তৃক শারীরিক লাঞ্ছনা বাংলার শিক্ষকসমাজকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে—কী হবে স্বপ্নের শিক্ষকতা পেশায় এসে?

যে শিক্ষক একজন ছাত্রের, তথা জাতির ভবিষ্যৎ তৈরি করার কারিগর, সেই শিক্ষক তাঁর নিজ ছাত্রের হাতে মার খেলেন! সেটাও প্রকাশ্যে অন্যান্য ছাত্রের সম্মুখে, যখন কিনা সেসব ছাত্র ২০২৪ সালে বোর্ড পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে বলে নির্বাচনী পরীক্ষা দিচ্ছিল।

গত রোববার শহরের ভিক্টোরিয়া জুবিলি (ভিজে) সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষক লাঞ্ছনার ওই ঘটনা ঘটে। বিদ্যালয়টিতে এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষা চলাকালে কক্ষ পরিদর্শক হাফিজুর রহমান পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের অভিযোগে বাণিজ্য বিভাগের এক ছাত্রের খাতা কেড়ে নেন।

এরপর খাতা ফেরত চেয়ে না পাওয়ায় ওই ছাত্র শিক্ষক হাফিজুর রহমানের গালে সজোরে দুটি চড় মেরে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যায়। আকস্মিক এ ঘটনায় ওই শিক্ষক হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার এ ঘটনার সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও চিত্র ওই দিন রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রধান শিক্ষক শেখ সফিয়ার রহমান থানায় মামলা করেন।

দায়িত্বরত শিক্ষক কেবল তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন, তাই খাতা কেড়ে নিয়েছেন। এটা শোধরানোর জন্য সাময়িক শাসনের অংশই বলব। ওই ছাত্রকে কিন্তু রুম থেকে বের করে দেননি! অর্থাৎ, একটু পরই হয়তো উনি খাতা দিয়ে দিতেন, অথবা ওই ছাত্র কিছুক্ষণ পর যখন ভুল স্বীকার করে খাতাটা চাইত, তখন খাতাটা দিয়ে দিতেন। পরীক্ষা হলে অনেক সময় এমনটাই করা হয়।

কোনো পরীক্ষার্থী যখন এ রকম কিছু অশোভনীয় কাজ করে, শিক্ষক তাকে সাবধান হতে বলেন। তবু সে সাবধান না হলে তারপর খাতা নিয়ে নেওয়া হবে বলে সংশোধনের শেষ সুযোগ দেন। তারপরও কোনো ছাত্র যদি অবাধ্যতা প্রদর্শন করে, তখন বাধ্য হয়ে খাতা নিয়ে নেওয়া হয়। তবে গুরুতরভাবে পরীক্ষার রুমের পরিবেশ নষ্ট না করলে হালকা কিছু সময় পর নিজ থেকেই শিক্ষক খাতা দিয়ে দেন। আর সেই ছাত্র যখন নিজের ভুল স্বীকার করে খাতা চায়, তখন শিক্ষক আবার তাকে ভুল না করার পরামর্শ কিংবা হালকা শাসনের স্বরে দু–চারটা কথা বলে খাতা দিয়ে দেন।

একজন শিক্ষক পাঁচটি বছর কী পড়ালেন, এর একটা যথোপযুক্ত পরীক্ষা নেওয়ার কিংবা মূল্যায়ন করার দরকার আছে। আর হাফিজুর রহমানের ওপর হাত তোলা এই ছাত্র তো তিন মাস পর বোর্ড পরীক্ষায় (এসএসসি) বসবে। তাকে আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা, তাকে আরও সঠিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এতেই ঘটল বিপত্তি? কী হবে এ জাতির ভবিষ্যৎ, যখন এদের মতো ছেলেমেয়েরাই আগামীর বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব দেবে?

হাফিজুর রহমান রাগে–ক্ষোভে ওই ছাত্রকে উত্তমমধ্যম দিতে পারতেন; কিন্তু না, দেখলাম তিনি দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন (হয়তো লজ্জা–অপমানে অশ্রুসিক্ত নয়নে)। কতটা আঘাত যে তিনি পেয়েছেন, তা আমরা কেবল ধারণা করতে পারি, আঘাতের গভীরতা কি আমরা জানি?

দেশে মানববন্ধন হচ্ছে, গণমাধ্যম কিছুটা প্রচার–প্রসার হচ্ছে, নিউজ চাউর হচ্ছে। এতে দু-চার দিন তাপমাত্রা নরম-গরম হবে, পরে আবার সব স্বাভাবিক হবে। কিন্তু ওই শিক্ষকের মনের গভীর ক্ষত শুকাবে না।

এখন কথা হলো, এই দুর্ভাগ্য কি কেবল হাফিজুর রহমানের? গোটা শিক্ষকসমাজের নয়? গোটা জাতির নয়? আমরা কোথায় যাচ্ছি?

একটা সন্তানকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তৈরি করতে হলে দায়িত্ব নিতে হবে সবাইকে। পরিবার একটা সন্তানের প্রথম শিক্ষালয়। তার আচরণিক ভিত্তি তৈরি হয় এখানেই। পরবর্তী সময়ে সেই আচরণ ও শিক্ষাকে পরিস্ফুট ও মার্জিত করা হয়। বহুমুখী প্রচেষ্টার ফলে একটা সন্তানকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা হয়। পরিবার থেকে সন্তান কী শিখছে, তাকে কি লায় দিয়ে দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে? তাকে কি গুন্ডা বানানো হচ্ছে?

নাকি সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, এটা নিবিড়ভাবে মূল্যায়ন করা দরকার। যে সন্তান তার শিক্ষাগুরুর ওপর চড়াও হতে পারে, সে নিকট ভবিষ্যতে তার জন্মদাতা মা-বাবার ওপরও চড়াও হতে পারে, এ হিসাব মোটেও ভুল নয়। আজ যে মা–বাবা তাঁদের সন্তানের এমন নীতিগর্হিত কাজকে সমর্থন করবেন, কাল সেই সন্তানের কাছ থেকে ভাবনাতীত আচরণ পাওয়ার জন্য তাঁদের তৈরি থাকতে হবে। যে হৃদয়ে পাপপুণ্যের বিচার করার মতো বীজ বপন করা হয়নি, সে হৃদয় থেকে সুন্দরের আশা করা বোকামি।

আমরা কোথায় যাচ্ছি? এখন শিক্ষকের গলায় জোটে জুতার মালা, ক্রিকেট স্টাম্পের আঘাত। কিছুদিন আগে চ্যানেল আইতে বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, ‘ছাত্রের কাছে শিক্ষকের কেবল একটিই জায়গা আছে, সেটি হলো শিক্ষকের চরণ স্পর্শ করা যায়, আর কোথাও স্পর্শ করা যায় না। সেই শিক্ষককে কোথায় নিয়ে এলাম আমরা?’ সত্যিই তা–ই। আমরা ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতায়ও পড়েছি।

‘শিক্ষক সুরক্ষা আইন’ চালু করার দাবি উঠছে। বিদ্যমান সমাজকাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে এ আইন হয়তো জরুরি। হয়তো এই আইন পাস ও চালু হতেও পারে। গভীর শঙ্কা, হৃদয়ের আর্তনাদ এখানে। শিক্ষক আজ মর্যাদা নিয়ে বাঁচার কথা ভুলে গিয়ে কেবল বাঁচার চিন্তা করছে। দেয়ালে কতটা পিঠ ঠেকে গেলে শিক্ষকসমাজকে আজ ‘শিক্ষক সুরক্ষা আইন’ কার্যকর করার তাগিদ দিতে হয়! এটি কি জাতির জন্য অশনিসংকেত নয়?

ভাবার সময় হয়েছে, রজনী গভীর হচ্ছে। সময় থাকতেই জাতিকে জাগতে হবে। সমস্যার মূল উৎস কোথায়, তা চিহ্নিত করতে হবে। দ্রুত সমাধান করতে হবে। নয়তো জাতি অমানিশার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে পথভ্রষ্ট হয়ে।

হাফিজুর রহমানদের হৃতগৌরব, হৃতমর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে। তাহলে জাতি সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের খোঁজ পাবে। এ জন্য সবাইকে সচেতন ও সচেষ্ট হতে হবে। আশা করি, জাতির ঘুম ভাঙবে শিগগিরই।

লেখক: সঞ্জিব কুমার রায়, শিক্ষক, কুড়িগ্রাম