একটি ট্যাবলেটের আত্মকাহিনি
বাজার থেকে তো অহরহ ওষুধ কিনে খাচ্ছি। এই ব্র্যান্ড, সেই ব্র্যান্ড। হরেক রকমের রং, সাইজ বা প্যাকেট। কোন ধরনের বিজ্ঞাপন ছাড়াই আমরা কিন্তু কিনতে বাধ্য হই। বলা যায়, না চাইলেও কিনতে হবেই আর কি। জীবন রক্ষাকারী ওষুধের কোন বিজ্ঞাপন হয় না, বাঁচতে হলে কিনতেই হবে।
ধরা যাক, আজ এক পাতা ট্যাবলেট কিনেছি। দামদর নিয়ে অনেক কথাই তো বলে যাই ফার্মেসিতে গিয়ে। দাম অবশ্যই নাগালের মধ্যে থাকুক—এটা সবাই আমরা চাই। তবে একটা ওষুধের জন্মগ্রহণের পেছনে কী এমন আছে! এর পেছনে অনেক বড় আত্মকাহিনি রয়েছে। কিছুটা জানা যাক।
প্রায় ৯৮ ভাগ ওষুধের জোগান দেয় বাংলাদেশের ওষুধ কারখানাগুলো। শুধু তা–ই নয়, এখন এই ওষুধ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আফ্রিকা ও ইউরোপের বাজারে যাচ্ছে।এখন পর্যন্ত নেই কোনো বড় ধরনের মার্কেট কমপ্লেইন। ঢাকা সিটি দূষিত নগরী হিসেবে চিহ্নিত হলেও এর আশপাশেই তৈরি হচ্ছে বিশ্বের মানসমৃদ্ধ ওষুধ। কীভাবে সম্ভব?
একটি ওষুধ প্রথমত বানাতে হয় ফর্মুলা অনুযায়ী, আর সেই ফর্মুলা ইচ্ছেমতো হয় না। ওষুধ তৈরি করার নিয়মনীতি বা গাইডলাইন অনুযায়ী তা বানাতে হয়। একই গাইডলাইন সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেকেই হয়তো জানেন না যে ওষুধ তৈরি করতে যে পরিবেশ, ল্যাব বা কর্মপদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, সেটা একদম যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ সামগ্রিক ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মতোই। আর তাই তো তারা আমাদের দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোকে তাদের মতো করে অডিট করে ওই দেশে ওষুধ রপ্তানি করার সুযোগ করে দিচ্ছে। আর তাদের সার্টিফিকেট অর্জন মোটেও সহজসাধ্য বিষয় নয়, কয়েক বছরের শত শত মানুষের অক্লান্ত শ্রম, নিয়মিত ইন্টারনাল আর মক অডিট পাস করানো, ওভারটাইম আর অত্যাধুনিক মেশিনের সব কার্যক্রম। শুধু সার্টিফিকেট অর্জনই সব নয়, সার্টিফিকেট রক্ষা করা আরও বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিনিয়ত বিদেশি সংস্থাদের অডিট লেগেই থাকে। বাংলাদেশের বুকে এক টুকরো আমেরিকান/ইউরোপিয়ান মানসমৃদ্ধ প্রোডাকশন এরিয়া, মাইক্রোবায়োলজি, আরঅ্যান্ডডি, কিউএ, কিউসি, ওয়্যারহাউস বজায় রাখা কিন্তু কম কথা নয়। এটা আমাদের জন্য বড় গর্বের বিষয়। এ ছাড়া আরও রপ্তানিমূলক বিভিন্ন দেশের অডিট তো লেগেই থাকে, যেমন তানজানিয়া, ফিলিপাইন, জিম্বাবুয়ে, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, ইয়েমেন, উগান্ডা ইত্যাদি। দেশ বড় ছোট ইস্যু নয়, প্রতিটা দেশের দক্ষ আর চৌকস অডিটর আসেন অডিট করতে। আর বাংলাদেশে সরকারিভাবে প্রতিনিয়ত অডিট করে ওষুধের গুণগত মান মনিটরিং করে যাচ্ছেন ডিজিডিএর অত্যন্ত অভিজ্ঞ, দক্ষ আর বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিরা। ওষুধ কারখানার প্রতিটি বিভাগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনের আদলে তাদের মতামত, নিরীক্ষণ আর সমীক্ষার মাধ্যমে অতি সুনিপুণভাবে দেশীয় ওষুধের মান আর কাঠামো দিনের পর দিন উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছে।
ওষুধের ফর্মুলা অনুযায়ী বানাতে গিয়ে হরেক রকম ট্রায়াল বানাতে হয়। বিভিন্ন তাপমাত্রায়, বিভিন্ন আর্দ্রতায় ট্রায়াল দিয়ে দেখা হয়, যাতে সেই ওষুধের গুণমান ঠিক আছে কি না। না থাকলেই আবার পুনরায় শুরু করতে হয়। আর এই কঠিন কাজগুলো করে থাকে আরঅ্যান্ডডি ডিপার্টমেন্ট। দিনরাত কাজ করে, গবেষণা করে ফর্মুলা তৈরি করে যাচ্ছে।
এরপর ওষুধ প্রোডাকশনের পালা। ফর্মুলা অনুযায়ী ওষুধ বানাতে হয়, একটু পর পর চেক করা হয়, নিয়ম অনুযায়ী সব হচ্ছে কি না। অনেক গুরুত্বপূর্ণ এই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে প্রোডাকশন ডিপার্টমেন্ট, সঙ্গে কিউএ ডিপার্টমেন্ট। ওষুধ তৈরির পর শুরু হয় গুণমান নির্ণয়ের কাজ। ওষুধের কোয়ালিটি চেক করা হয় বিভিন্ন টেস্টের মাধ্যমে। একটু কম–বেশি হলেই কিন্তু কোনো ছাড় নেই। লিমিট অনুযায়ী সেই ট্যাবলেটকে পাস করতেই হবে। সবকিছু ঠিক থাকলেই কেবল সেই ওষুধ রিলিজ দেওয়া হয়, তারপরে বাজারে ছাড়া হয়। আর এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করে যাচ্ছে কিউসি এবং মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্ট। ওষুধ তৈরি করার রুমের বাতাস, পানি, মেশিন এমনকি অপারেটরদের পোশাকও টেস্ট করা হয়।ওষুধের স্টেবিলিটি চেক করা হয় বিভিন্ন তাপমাত্রায়–আর্দ্রতায়। কারণ, সেই ট্যাবলেট গ্রামের টিনের দোকানেও বিক্রি হবে, আবার শহরের এসি রুমেও বিক্রি হবে। ওষুধ গ্রাহকের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সামগ্রিক বিষয় দেখভাল করে কিউএ ডিপার্টমেন্ট। রেগুলেটরি বিষয়গুলো সুনিপুণভাবে দেখভাল করে রেগুলেটরি ডিপার্টমেন্ট। বাতাস, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ সামগ্রিক টেকনিক্যাল বিষয়গুলো খুব দক্ষতার সঙ্গে দেখে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট। এইচআর খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে মানবসম্পদ উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছে আর অ্যাডমিন দেখে সব ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট আর স্বাস্থ্য-পরিবেশগত নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলো।
এভাবে কারখানায় প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে শত শত মানুষ কাজ করে যাচ্ছে শুধু ভালো একটা ওষুধ বানানোর জন্য। পর্দার আড়ালেই এরা কাজ করে যাচ্ছে দিনরাত। করোনা মহামারি, রোদ–বৃষ্টি, হরতাল, অবরোধে কিন্তু ট্যাবলেটের জন্মগ্রহণ আর লালন–পালন থামাতে পারেনি আর কখনো পারবেও না।
তাই একটি ট্যাবলেট শুধু টাকার বিনিময়েই একটি পণ্য নয়, এটা শত শত মানুষের দেশপ্রেমের একটি নিদর্শন, ভালোবাসা আর শ্রমের বিনিময়ে একটা আত্মত্যাগের টোকেন। যে দেশপ্রেমের নেই তেমন কোনো মিডিয়া কভারেজ, নেই কোনো হাঁকডাক। নীরবে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছে দেশের প্রতিটি মানুষের সুস্থতার জন্য।
*লেখক: মনোজিৎ কুমার রায়, ওষুধশিল্পের একজন গর্বিত কর্মী।