আপসহীনতা যাঁর পরিচয়
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আমি যখন লেখাটি লিখছি, সারা দেশর মানুষ তখন শোকে স্তব্ধ। কারণ, আজ সকালে (৩০ ডিসেম্বর ২০২৫) বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ও অভিভাবক খালেদা জিয়া মৃত্যুবরণ করেছেন। আপসহীনতা, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও দেশ পরিচালনার মাধ্যমে মানুষের জীবনমান উন্নয়নে দৃঢ ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খালেদা জিয়ার নাম উচ্চারিত হবে এক বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে। তিনি শুধু একজন সাবেক ফার্স্ট লেডি বা প্রধানমন্ত্রীই নন; তিনি নারী নেতৃত্ব, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আধিপত্যবাদবিরোধী, দেশের স্বাধীনতা, সংগ্রাম ও স্বার্বভৌমত্বের শক্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। ৮০ বছর জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় একটি দলের প্রধান হয়ে দেশ ও জাতি গঠন এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি যে সংগ্রাম করেছেন, তা অকল্পনীয় এবং এসব নানাবিধ কর্মকাণ্ডের কারণে মানুষ তাঁকে আজীবন স্মরণে রাখবে।
মাধ্যমিকে পড়া অবস্থায় সম্ভবত ২০০৪ সালে আমার নিজ উপজেলা মহেশপুরে তাঁকে প্রথম দেখি। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের উদ্বোধন শেষে জনসভায় ভাষণ দেওয়া দৃশ্য এখনো চোখের সামনে ভাসছে। তাঁর সরকারের আমলে আমাদের মহেশপুর কোটচাঁদপুর আসনে যেকোনো সময়ের থেকে বেশি বিদ্যুতায়ন, রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো নির্মাণ, চাকরি, স্কুল–কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছিল। ফলে আজকের অন্তিমযাত্রার দিনে উপজেলায় তাঁকে প্রথম দেখার স্মৃতি আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া অবস্থায় একবার দেখেছিলাম। বলতেই হবে, গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে আসা একজন নারীর পক্ষে বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েও যে দৃঢ়তা, আত্মমর্যাদা ও নেতৃত্বের ভার বহন করা যায়, তিনি তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপে সেটিই প্রমাণ করেছেন।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার ভূমিকা ঐতিহাসিক। তাঁর নেতৃত্বে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেন, যা ছিল তাঁর নেতৃত্বের অন্যতম বড় অর্জন। ১৯৯১ সালে সরকার গঠনের পর তিনি নারীদের জন্য বাস্তবভিত্তিক নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর দূরদর্শী চিন্তার ফসল হিসেবে বিনা বেতনে অধ্যয়ন, উপবৃত্তি কর্মসূচি বিস্তৃতকরণ, গ্রামীণ ও প্রান্তিক নারীদের স্কুলে উপস্থিতি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এই উদ্যোগ নারীকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করেছে।
রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাঁর আপসহীনতা। ফলে নানা ষড়যন্ত্র, শারীরিক অসুস্থতা কিংবা রাজনৈতিক নিপীড়ন—কোনো কিছুই তাঁকে নীতিগত অবস্থান থেকে সরাতে পারেনি। ক্ষমতার বাইরে থেকেও তিনি বারবার গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। তিনি শুধু নিজ দলের বা কর্মীদের কথাই বলেননি, অন্য দলের অধিকার রক্ষার জন্যও কাজ করেছেন। ২০০৭ সালে ধানমন্ডির বাসা থেকে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হলে পরদিনই তাঁর মুক্তি চেয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তিনি দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। দেশের অর্থনীতি মোটাদাগে দাঁড়িয়ে আছে কৃষি, গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্সের ওপর, যা শুরু হয়েছিল জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। খালেদা জিয়া জিয়াউর রহমানের দেখানো পথে হেঁটেছেন সব সময়। এই পথে হাঁটতে তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে, বিসর্জন দিতে হয়েছে অনেক কিছু। তারপরও তিনি নীতিতে অবিচল থেকেছেন আজীবন। এই দৃঢ় অবস্থানই তাঁকে শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা নয়, বরং প্রতিরোধ ও সাহসের প্রতীকে পরিণত করেছে।
বাংলাদেশ একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল খালেদা জিয়াকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিজেদের অভিভাবক হিসেবে মেনে নিয়েছেন। এই সংকট মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এতটা ভালোবাসা, দোয়া ও সম্মান নিয়ে কতজন পরকালের পথে রওনা হতে পারে?
মো. শাহিন রেজা, বেসরকারি হাসপাতালের কর্মী