না আদম না শয়তান

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ইজি চেয়ারে শরীরটাকে এলিয়ে দেওয়ামাত্র একদম মরার মতো পড়ে থাকে সে। তবে সেটা খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। বিকট একটা শব্দে তার ঘুমের রেশ কেটে যায়। গোঙানির শব্দে পুরাপুরি জেগে ওঠে। শব্দটা টয়লেটের দিক থেকে আসছে বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় নেয় সে। এক দৌড়ে সেখানে পৌছে যায়। একজন বোর্ডারকে টয়লেটের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে। গোঙানির শব্দ বলে দিচ্ছে, বেশ আঘাত পেয়েছে। নিজে থেকে উঠার মতো অবস্থায় নেই। ইস্ট লন্ডনের হোয়াইটচ্যাপেল রেলস্টেশন থেকে মিনিট সাতেক হাঁটলে লন্ডন ইসলামিক স্কুল। তারই উত্তর-পশ্চিম কোনে বেশ বড় জায়গা নিয়ে এই ইউটোপিয়া ওল্ড হোম। কাউন্সিল ও চ্যারিটির যৌথ প্রয়াসে চলা সাপোর্টেড হোম হিসেবে এর যথেষ্ট সুনাম আছে। ঘুম থেকে টের পেয়ে হুসেন কিছুটা হচকচিয়ে যায়। আগে এরকম কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি তাকে। যদিও হুসেন অনেক দিন ধরে এই ইউটোপিয়া সাপোর্টেড হোমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

একটা বয়সের পর নিজে চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়লে সাপোর্টেড হোমগুলো তাদের দায়িত্ব নেয়।

সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সেখানে যে কেউ স্বেচ্ছাশ্রম দিতে পারে। হুসেনের সঙ্গে ইউটোপিয়ার দীর্ঘদিনের জানাশোনা। শুরুতেই এই ওল্ড হোমের সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো আদালত।

নিয়মিত অপরাধে জড়িত নয়, এমন অপরাধীকে আদালত কখনো কখনো ওল্ড হোমে পাঠায়। সেখানে সেবা দিয়ে নিজেকে সংশোধনের সুযোগ করে দেয়। আদালত শাস্তির বদলে হুসেনকে পাঠিয়েছিলো ইউটোপিয়া সাপোর্টেড হোমে। সেখানে সেবার মান ও নিজেকে শুধরে নেওয়ার বিষয়টার একটা আমলনামা তৈরি হয়। নির্দিস্ট সময় পরপর সেটা আদালতে পেশ করা হয়। স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে হাজিরাও দিতে হয়। শুরুতে হুসেনের জন্য এ বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে সময় কাটানো শাস্তি মনে হলেও আস্তে আস্তে সেখানে বেশ ভালো লেগে যায়। ঘটনার দিন সন্ধ্যা থেকে হুসেনের ডিউটি ছিল ইউটোপিয়া সাপোর্টেড হোমের দেখভাল করার। হুসেনের কাজে মুগ্ধ হয়ে আদালত নির্দিস্ট সময়ের আগেই ছাড়পত্র দিয়েছিল। কিন্তু সে ইউটোপিয়ার মায়ায় বেশ জড়িয়ে পড়েছে। সপ্তাহে অন্তত একদিন এখানে সময় দেয় হুসেন। কিন্তু হুসেনের বিষণ্নতা কাটে না। আজ সে তার লক্ষ্য থেকে বহু দুরে ছিটকে পড়েছে।

বেশ কিছুদিন হল টেসকোতে কাজ করে হুসেন। একজন সহকর্মী অসুস্থ হওয়ায় অতিরিক্ত চার ঘণ্টা কাজ করতে হয়েছে তাঁকে। অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারনে হোমে এসে বেশ ক্লান্ত লাগছিল। কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে ইজি চেয়ারে আসীন হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে। সেটাও হয়তো মিনিট দশেক হবে। তখনই বাথরুমে একটা বিকট শব্দে জেগে ওঠে সে। শুরুতে হচকচিয়ে গেলেও এরপর পরেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় হুসেন। বিশেষ ধরনের লিভার ব্যবহার করে বরিসকে টয়লেট থেকে বের করে হুইল চেয়ারে ওঠায়। অল্প কিছুদিন হলো এখনাকার বোর্ডার হয়েছে বরিস। সাপোর্টেড হোমে আসার মতো যথেষ্ট বয়সও নয় তার। কিন্তু এই বয়সেই বরিসের শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় তার ঠিকানা হয় এ ওল্ড হোম। ইমার্জেন্সি সার্ভিসে ফোন দিয়ে নিজেও রেডি হয় হুসেন। ডেটাবেইজে থেকে নম্বর নিয়ে বরিসের গার্ডিয়ানকেও কল করে। ফোনে না পেয়ে ভয়েস টেক্সট দিয়ে রাখে। ৫ মিনিটের আগেই কুইক রেসপন্স টিম হোমের সামনে চলে আসে। যার কেউ নেই, তার জন্য রাষ্ট্র আছে। প্রত্যেক নাগরিক রাষ্ট্রের নিকট খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশে এ বিষয়টা হুসেনের খুব ভালো লাগে। ওদের সঙ্গে রয়্যাল কাউন্টি হাসপাতালে চলে আসে হুসেন। বরিসকে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করা হয়।

হাসপাতালের পরিচালক বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বরিসের ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করেন। এখন হুসেনের বলতে গেলে করনীয় কিছু নেই। তারপরেও সে হাসপাতাল ত্যাগ করে না। বরিসের গার্ডিয়ান হয়তো চলে আসবে। তারা এলে সে সাপোর্টেড হোমে ফিরবে। সেখানে আরও অনেক মানুষের দেখভালের দায়িত্ব তার। হুসেনকে ওল্ড হোমের অথরিটিকে মেইল করে জানাতে হবে। হাসপাতালের লবি ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল। একটা যুতসই যায়গা পেলে বসে মেইলটা করে নেবে। সামনে একটা ওয়েটিং রুম দেখতে পেয়ে ভেতরে ঢুকে। ভেতরের পরিবেশ দেখে হুসেনের মনটা ভালো হয়ে যায়। থরে থরে সাজানো বই। নানা দেশের নানা ভাষা থেকে অনুবাদ করা। মাহমুদ দারবিশের একটা বই চোখে পড়ে। সেটা হাতে নিয়ে পেয়ে উল্টাতে থাকে। দারবিশের অনেক নাম শুনেছে। আগে কখনও পড়া হয়নি।

‘…যেসব পাখির দল জেনেছিল আমার হাতের তালু
অদূরবর্তী বিমানবন্দরের ফটক
যত শস্যের মাঠ
বন্দিশালা
সফেদ সমাধির পাথরগুলো
কাঁটাতার ঘেরা সীমান্ত
বাতাসে দুলতে থাকা কারুকাজগুলো
সকল দৃষ্টি

ছিল আমার নিজের,

অথচ আমার পাসপোর্ট থেকে সকল কিছু কারা যেন উধাও করে দিয়েছিল…।’
হুসেনকে বেশ টানতে থাকে দারবিশ ও তাঁর কবিতা। তার খেয়াল থাকেনা অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে।

—তুমি আমার পাপাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছো? আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ।

একটি মেয়ের কন্ঠ শুনতে পেয়ে দারবিশের ঘোর থেকে বের হয়ে আসতে বাধ্য হয়। কিন্তু পেছনে ফিরেই ভীষণ চমকে যায়। কোনোভাবে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। হুসেনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্যালি। হাতে থাকা দারবিশের বইটা পড়ে যায়। ঠিক যেভাবে একদিন হুসেন নিজে পড়ে গিয়েছিলো, স্যালির মোহের জগতে। হুসেন নিজেকে সামলে নেয়। স্যালির দিকে দ্বিতীয় বার নজর দেওয়ার আগে ফ্লোরে পড়ে থাকা দারবিশকে তুলে নেয়। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে খুব বেশি লাভ হয় না। তার সঙ্গে করমর্দনের জন্য মেয়েটির বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা একদম দেখতে পায় না সে। তার বদলে হুসেন ভাবে, স্যালি তাকে খুঁজে পেল কীভাবে। নিজের গলায় ওল্ড হোমের আইডির রিবনটার কথা মনে আসে।  

—আমি, মিস মেরি। বরিসের মেয়ে।

নামটা শুনে আরেকবার ধাক্কা খায় হুসেন। বাদামি রঙ্গের চুল, বিড়ালের কোটর থেকে বের হয়ে আসা নীলাভ চোখ। সেই চোখ দুটো নীলের অতলস্পর্শী গভীরতায় আকর্ণ। আর দশটা মেয়ের চেয়ে বেশ লম্বা হলেও শরীরে এক ছটাক মেদও নেই। লো-লেন্থে ববকাটের ডিজাইনে চুলের বিন্যাস নন্দনতত্ত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। তীক্ষ্ণ গ্রীবা, এমনকি হাঁটার ভঙ্গি—স্যালির অবিকল। এই মেয়ের নাম মেরি হবে কোন দুঃখে! অবিশ্বাস্য!

—তোমার তৎপরতায় খুব দ্রুত পাপাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। কুইক রেসপন্স টিম তোমার খুব সুনাম করল। কীভাবে যে তোমাকে ধন্যবাদ জানাবো!

আরও কি যেন বকে যাচ্ছিল মেয়েটি। সেই মেয়েটি, যে নিজেকে মিস মেরি নামে চালিয়ে নিতে চায়। কিন্তু হুসেন এখনও বিশ্বাস হয়না, সে মেরি নয়, স্যালি।

২.
মনে হয় এ তো সেদিনের কথা। মাত্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। কিন্তু অনেক দেশের আকাশে তখনো নতুন সূর্যের দেখা মেলেনি। বরং তার বদলে তাদের ওপর জগদ্দল পাথর চাপিয়ে দেয় পরাশক্তিরা।

ফিলিস্তিনের আকাশেও তেমনি একদল কালো মেঘের ঘনঘটা। খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারের পাতায় সময়টা তখন ১৯৪৮ সাল। পশ্চিম তীরের ছোট্টগ্রাম কেফার ইতজিয়নে হঠাৎ করে যেন গজব নেমে আসে।

ব্রিটিশ আর্মির একটা পদাতিক দল তখনো ফিলিস্তিন ছাড়েনি। হঠাৎ একদিন সেই বাহিনী এলোপাথাড়ি গুলি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে চারদিকে। সেই গুলির অর্থ ছিল ৩ দিনের মধ্যে কেফার ইতজিয়ন খালি করতে হবে। তখনো আবিদালরা জানতনা, শুধু কেফার ইতজিয়নে নয়, নাবলুস, পশ্চিম তীর, গাজা, রামাল্লাসহ দেশজুড়েই এ রকম দখল-উৎখাত চলছে। অথচ কিছুদিন আগেও জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নিপীড়নের স্বীকার হয়ে জাহাজবোঝাই ইহুদিরা আসছিল। তাদের বহন করে নিয়ে আসা জাহাজে লেখা থাকত, ‘জার্মানরা আমাদের পরিবার ও বাড়ি ধ্বংস করেছে, তোমরা আমাদের স্বপ্ন ধ্বংস করো না।’ সেই কথাটা এখন কতটা নির্মম ও হাস্যকর শোনাচ্ছে। রাতারাতি আশ্রয়দাতারা হয়ে গেল ভূমিহীন। সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকও এতটা নিমকহারাম হতে পারে না। সেই শুরু, দলে দলে ফিলিস্তিনদের উৎখাত করার মিশন। ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস।

সেদিনের অসহায় ইহুদিরা আবিদালদের ঘরগুলোকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া শুরু করল। সেখানে নির্মাণ শুরু হলো নতুন ভবন। আবিদালদের কোন চিহ্ন রাখতে চায় না ওরা। যুদ্ধে বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনিদের কাছে সেটা ছিলো দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ানক কিছু। তবু ওরা আশায় আশায় থাকে। আশা করে, বিশ্ব বিবেক জেগে উঠবে। যেকোন সময় সে দুঃস্বপ্ন শেষ হয়ে আসবে। কিন্তু ওদের ধারনা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে কয়েক দিন পর দখলদারেরা আবার দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে নির্বিচারে গুলি শুরু করে। যারা নিজেদের ঘর ফিরে পাবার জন্য রাস্তায় নেমেছিলো, তাদের কেউ গুলি খেয়ে সেই ঘরের সামনেই পড়ে থাকল। হাজার আবিদাল তখন নিজ গৃহে পরবাসী, এলিয়েন ইন হোমল্যান্ড। এরপরের দিনগুলা ছিল চরম দুর্বিসহ, আরও ভয়াবহ। জীবন বাঁচানোর তাগিদে, দিনের পর দিন বহু বাধা পেরিয়ে, ছুটতে ছুটতে আবিদাল একদিন পৌঁছে যায় ইস্তাম্বুলে। তুরস্কের বৃহত্তম শহরে। ইসমত ইনোনু সরকারের দেয়া রিফিউজি কলোনিতে আবিদালের আশ্রয় জোটে।

ইস্তাম্বুলের রিফিউজি কলোনিতে জন্ম হয় হুসেনের। ছোটবেলায় দাদু আবিদালের কাছে অনেকবার এ গল্প শুনেছে হুসেন। এরপর অনেক দিন কেটে গেছে। তুরস্কের পাসপোর্ট হুসেনকে পৌঁছে দেয় গিল্ডফোর্ড নামক ইংল্যান্ডের ঝাঁ–চকচকে ছোট শহরে। কিন্তু হুসেনের হৃদয়ের একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে দাদা আবিদালের কাছ থেকে শোনা কেফার ইতজিয়ন। কখনো–বা পুরো ফিলিস্তিন। ঘরহারা, দেশছাড়া আবিদালকে বেঁচে থাকার সাহস জুগিয়েছিল তার রান্নার হাত। কেউ একবার আবিদালের হাতের আফগান বিরিয়ানি, কাবাব, মসল্লাম খেলে স্বাদ মুখে লেগে থাকত। কিন্তু আবিদাল ইস্তাম্বুলের মত ব্যস্ত শহরের জীবনের রেসে বেশি দূর আগাতে পারেননি। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল নতুন দেশের নতুন ভাষা।

আবিদালের ঐ বয়সে নতুন করে শেখার সময় ছিল না। কিন্তু দাদা আবিদাল হুসেনের বাপকে ইংরেজি শিখিয়েছিলো। সে সুবাদে হুসেনের টুরিস্ট গাইড বাবার কাজটা ছিলো বেশ সম্মানের। হরেক দেশ থেকে আসা টুরিস্টদের তুরস্কের ইতিহাস, ঐতিহ্য তুলে ধরে জীবন কেটে গেছে। সুযোগ পেলে ফিলিস্তিনের গল্পও শোনাত। বাবা অসুস্থ হলে হুসেনও অনেক দিন বদলি ডিউটি করেছে। কাজটা হুসেনেরও বেশ লাগত। কিন্তু হুসেনের দাদা আবিদালের স্বপ্ন ছিলো, সে যেন জগৎজোড়া খ্যাত আইনজীবী হয়।

দখলদারদের হাত থেকে ফিলিস্তিনকে ফিরিয়ে আনতে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেবে। ছোটবেলা থেকে ফিলিস্তিনের গল্প শুনতে শুনতে দাদা আবিদালের স্বপ্ন কখন যে নিজের ভেতর বেড়ে উঠেছে, টের পায়নি। ফিলিস্তিনজুড়ে দখলদারদের নির্বিচার অত্যাচার চললেও পশ্চিমা মিডিয়ার নগ্ন হস্তক্ষেপ দুনিয়ার কাছে অজানাই থাকে। যুগ যুগ ধরে সেটাই চলে এসেছে। দখলদারদের ফাঁকি দিয়ে কোনো কোনো সংবাদ পশ্চিমের মিডিয়ায় পৌঁছাত। সে রকম সংবাদ পেলে বরাবর বেশ মুষড়ে পড়ে হুসেন।

৩.

বছর দুয়েক আগের কথা। মাত্রই ইস্তাম্বুলের শহরতলি থেকে হুসেন গিল্ডফোর্ডে এসেছে। সেন্ট্রাল লন্ডন থেকে দেড় ঘণ্টার ড্রাইভিং–দুরত্বে গিল্ডফোর্ডের অবস্থান। আন্তর্জাতিক আইনের ওপর পিএইচডি করতে ভর্তি হয়েছে সারে ভার্সিটিতে। ইস্তাম্বুল ভার্সিটি থেকে আইনের ওপর দুর্দান্ত রেজাল্ট করেছে। ভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করার সুযোগ ছিল। হুসেন সে পথে হাঁটতে চায়নি। সে চায় দাদা আবিদালের স্বপ্ন পূরণ করতে। ছিমছাম হিলি টাউন গিল্ডফোর্ডকে শুরুতেই বেশ ভালো লাগে হুসেনের। লন্ডনের বেশ কাছাকাছি অথচ খুব একটা কোলাহল নেই। গিল্ডফোর্ডের প্রাণকেন্দ্রে আছে একটা উঁচু ক্যাথেড্রাল। তাঁর পাশেই স্টাগহিলে ভার্সিটির প্রধান ক্যাম্পাস। শহরের যেকোন জায়গায় দাঁড়ালে ক্যাথেড্রালের ওপরে থাকা ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মূর্তি নজরে আসে। ছোট শহর, তার ওপর ক্রুশের রাজ-তিলক কাউকে হারাতে দেয় না। কয়েক দিন আগেও হুসেন ছিল ইস্তাম্বুলের ঘিঞ্জি কলোনির স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে বেড়ে ওঠা একজন রিফিউজি। গিল্ডফোর্ডে সেই পরিচয়টা থাকছে না। সব মিলিয়ে এই পরিবেশকে স্বপ্নের মত মনে হয়।

গিল্ডফোর্ডের বেনব্রিক রোডে হুসেনের বাস। এই রোডটা কানাগলির মতো। হিলের ওপরের দিকে উঠে ক্যাথেড্রালের নিচে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে বেনব্রিক রোড। সে কারণে রোডের শুরুতে Cul-De-Sac লিখে দেওয়া। যাতে মানুষ ধোঁকায় না পড়ে। রোডে ঢোকার মুখেই আটটা রুম নিয়ে হুসেনের ডরমিটরি।

এর আড়াই তলায় হুসেনের রুম। দোতলা থেকে একটা ছোট্ট মই বেয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করতে হয়।

রুম নয় বরং এটাকে শুরুতে পাখির বাসার মতো লাগে। পাখিদের নিজেরদের ঘর থাকে? অনেক পাখির ঘর থাকলেও হুসেনদের সেটা কখনোই ছিলো না। কেফার ইতজিয়ন থেকে ইস্তাম্বুলের রিফিউজি কলোনি, সেখান থেকে গিল্ডফোর্ড। জানালার পাশে পড়ার টেবিলে বসলে শহরের সঙ্গে আকাশটারও অংশ বিশেষ দেখা যায়। শহরে ইলেক্ট্রিসিটি যায় না বললেই চলে। তারপরও কোনো কোনো দিন লোডশেডিং হলে জানালার কাচ গলে রুমের ভেতর অন্ধকার ঢুকে যায়। সেই অন্ধকারে বসে গিল্ডফোর্ডের আকাশ দেখতে বেশ লাগে। এই একই আকাশটাই তো ইস্তাম্বুলের ওপর, থাকে কেফার ইতজিয়নের ওপরেও। একই আকাশের নিচে জীবনের কত রং, কত বিচিত্রতা।

৪.

তুমি কারও জন্য অপেক্ষা করছ? বেনব্রিক রোডের কাছেই ওভাল পার্ক। পার্কের বেঞ্চে বসে ভিন দেশের হরেক রকমের মানুষ দেখছিল হুসেন। এ সময় একটা মেয়ে তাঁকে প্রশ্নটা করে বসে।

হুসেনের হাতে তখন অনেক সময়। কয়েক দিনেই শহরের আশপাশটা দেখা হয়ে গেছে। বলতে গেলে শহরে সবাই অচেনা মুখ। ডরমিটরিতে মাইকেল ও সাইদের সঙ্গে টুকটাক আলাপ হয়। ওরা পড়াশোনার ফাঁকে কাজ করার পরামর্শ দেয়। সময়ও কাটবে, কিছু পয়সাও পাওয়া যাবে। সবাই তাই করে, হুসেন শুনেছে। সে কাউকে চেনে না, কাজ কীভাবে পাবে। ওভালে বসে সেটা নিয়ে ভাবছিল। কিছু নিয়ে ভাবতে গেলে সেখানে ইস্তাম্বুলও চলে আসে। ইস্তাম্বুলের ঘিঞ্জি কলোনিতে হুসেনের জীবনটা ছিল অনেক কষ্টকর। তবু সে ইস্তাম্বুলের প্রতি কৃতজ্ঞ। কেফার ইতজিয়নের পথে ঘাটে ঘাতকদের গুলিতে মরে পড়ে থাকতে হয়নি। ইস্তাম্বুল আশ্রয় দিয়েছিল বলেই আজ হুসেনের জীবনটা অন্য রকম। গাজা কিংবা পশ্চিম তীরের যেকোন ছেলের চেয়ে সে ভাগ্যবান। তবুও একাকি সময় তাকে বিষণ্নতায় ঠেলে দেয়। সেটা কাটিয়ে ওঠার জন্য মাঝেমধ্যে এই পার্কে আসে। এক কোনায় একটা বেঞ্চে বসে বাচ্চাদের খেলা দেখছিল।

এমন সময়ে স্যালি এসে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি কারও জন্য অপেক্ষা করছ? হুসেন ঘাড় ফিরিয়ে প্রথমে নিশ্চিত হতে চায়, কথাটা তার উদ্দেশ্যে বলা কি না। মেয়েটার দিকে তাকালে মিষ্টি হাসি দিয়ে হুসেনের পাশে বসে পড়ে। হুসেন বুঝতে পারে, কিছু না বলাটা খুব অভদ্রতা হবে।

—আমি বাচ্চাদের খেলা দেখছিলাম। হুসেন একটু ঘুরে বসে। এবং সুন্দর হাসিমুখ করে মেয়েটির কথার উত্তর দেয়। এবার হুসেন মেয়েটিকে ভালোভাবে খেয়াল করার সুযোগ পায়। বেশ লম্বা সোনালি চুল। গাঢ় নীল চোখে এক সমুদ্র গভীরতা। ওকে ঠিক মর্তের মানবী মনে হয় না। হুসেন জানে সে একদম নতুন। তাই খুব সতর্ক থাকে। কথা খুব বেশি দূর এগোয় না। বিদায় দিয়ে, কাজের ব্যস্ততার কথা বলে হুসেন ওভাল ত্যাগ করে।

৫.

স্যালির পরামর্শে ফুড ডেলিভেরির কাজ নেয় হুসেন। ওভালের বেঞ্চ থেকে দ্রুত তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এর পুরা কৃতিত্ব বলা যায় স্যালির। সেদিন কাজের কথা বলে চলে আসে বটে কিন্তু স্যালিকে দেখার আশায় আবারও ওভালে যায়। স্যালির মধ্যে এক ধরনের মাদকতা আছে। হুসেন ভয় পায়, স্যালির মাদকে সে যেন আটকে না পড়ে। কিন্তু স্যালির সঙ্গে আবারও দেখা হয়। সেই ওভালেই স্যালি তার জীবনের গল্প শোনাতে চাইলে না করতে পারে না। জাতিতে কুদসি স্যালির পূর্বপুরুষের আবাস ইরাকে। হুসেন খেয়াল করে, আশ্চর্যজনকভাবে এক জায়গায় এসে স্যালির গল্পের সঙ্গে ওর গল্প খুব মিলে যায়। একই মিশন নিয়ে চলা দুজন মানুষকে খোদা কীভাবে ঠিক মিলিয়ে দেয়। সেই থেকে স্যালির সঙ্গে হুসেনের সম্পর্ক দ্রুত বদলায়। একটা সময় পরে বেনব্রিক রোডের ডরমিটরি ছেড়ে জনসন রোডে স্যালির বাসায় ওঠে। হুসেন স্যালির সঙ্গে লিভ-ইনে চলে যায়। হুসেন ভেবে দেখে, নাবলুসের পথে গুলি খেয়ে বেঘোরে মরে পড়ে থাকতে হতে পারত। তার বদলে স্যালির সঙ্গ অমৃতের মতো। সত্যি জীবনের এমন একটি বেহেশতি রূপ আছে, স্যালির হাত ধরে সেটার সঙ্গে পরিচয় হয়।

৬.

বিন্দু বিন্দু জল সাগর তৈরি করে। সেই জলের অতি উচ্ছ্বাসে ঝড় ওঠে। সেই ঝড় বাতাসের দমকে ডাঙায় এসে আছড়ে পড়ে। বুঝে উঠার আগেই চুরমার হয় কত শত বসতি। হুসেনের জীবনটাও ঠিক সেই রকম। স্বপ্নের মতো হঠাৎ করে পাওয়া বেহেশতি বাগানে কালবৈশাখী এসে আছড়ে পড়ে। চুরমার হয় হুসেনের স্বপ্ন। স্যালির সঙ্গে মাত্রই থাকা শুরু করেছে। একদিন ডেলিভারি দিতে যাওয়ার পথে পুলিশ হুসেনকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। ওদের গাড়িতে করে পুলিশস্টেশনে নেওয়া হয়। ওর ডেলিভারি পার্সেলে ভয়াবহ মাদক আইস পাওয়া যায়। কোর্টে হুসেনের বিচার শুরু হয়। স্যালির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পারেনি। হুসেনের দাদা আবিদালের স্বপ্ন চুরমার হতে থাকে। একদম তীরে এসেই হুসেনের স্বপ্নের তরি ডুবতে থাকে। ভালো স্কলারশিপ নিয়ে হুসেন সারেতে এসেছিল। আদালত থেকে ভার্সিটি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। সব বিবেচনায় নিয়ে হুসেনকে ইউটোপিয়া সাপোর্টেড হোমে পাঠানো হয়। হুসেনের কর্মনিষ্ঠা ও সততার ৮ মাসের মাথায় ইউটোপিয়ায় বাধ্যতামূলক সেবা হতে অব্যাহতি পায়। কিন্তু ভার্সিটিতে নতুন করে রেজিস্ট্রেশনের অনুমতি পায় না।  ৮ মাসে ইউটোপিয়ার সঙ্গে হুসেনের গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। সপ্তাহে অন্তত একদিন এখানে এসে স্বেচ্ছাশ্রম দেয়। সেখানেই বরিস জনসনের।

অ্যাক্সিডেন্ট, এরপরেই মিস ম্যারির আগমন। মিস মেরি এসে স্যালির কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই ঘটনার পর থেকে স্যালিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে হুসেন। কোনোদিন দেখা হলে জিজ্ঞেস করবে, কেন সে তাঁর জীবন ও তাঁর দাদা আবিদালের স্বপ্নকে এভাবে ধ্বংস করার জন্য তাঁর জীবনে এসেছিল।

৭.
আজ আর কোনো কাজ নেই। সন্ধ্যায় মাইনুল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করবে ভেবেছে। গিল্ডফোর্ডে তাঁর বিপদের সময় তিনি বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন। তিনি একজন বাংলাদেশি। তারপরও তাঁকে সব সময় নিজের ভাইয়ের মতো মনে হয়েছে। অথচ এর আগে বাংলাদেশ কিংবা এ দেশের মানুষের বিষয়ে হুসেন কিছুই জানত না। মাইনুল ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের পর জানতে পেরেছে, ওদেরও একটা রক্তাক্ত যুদ্ধের ইতিহাস আছে। পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হতে জান দিতে হয়েছে ৩ মিলিয়ন মানুষকে। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার আগ্রহ অনেক বেড়েছে। সে বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও জানতে চায়।

গতকাল সন্ধ্যায় হুসেন হাসপাতাল থেকে ইউটোপিয়া হয়ে গিল্ডফোর্ডে তার রুমে ফেরে। গত কয়েক দিন হুসেনের ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। ফ্রেশ হয়ে বেডে যাওয়ামাত্র একটা লম্বা ঘুমে চলে যায়। পরের দিন দুপুরের পর ঘুম ভাঙে, তবুও আলসেমি কাটে না। তারপরেও উঠে দাঁড়ায়। পা ফেলে ফেলে গেটের কাছে চলে আসে। অনেক দিন লেটার বক্স চেক করেনি। বক্সের লক খোলে। অনেক চিঠি জমা হয়েছে।

এদের এখানে প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে অনেক চিঠি আসে। চিঠি দেখে দেখে শর্টিং করতে থাকে।

একটা চিঠি খুলে হুসেন চমকে ওঠে। আদালতের চিঠি। মাদক ডেলিভারির বিষয়টি একদম সাজানো।

হুসেনের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। মিডেল ইস্টের একটি গোয়েন্দা সংস্থার ষড়যন্ত্রে হুসেনকে ফাঁসাতে স্যালিকে কাজে লাগিয়েছে। স্যালিও সেই দেশের নাগরিক ও সেই গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করে। তাঁকে সেই দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। সেই দেশের হাইকমিশনারকে ডেকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, পুলিশকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

হুসেন চিৎকার করে ওঠে। আনন্দে কী করবে, ভেবে পায় না। ভার্সিটিতে আবার ক্লাস শুরু করতে পারবে। সে কথাও বলা আছে। হুসেন লাফ দিয়ে ওঠে। দাদা আবিদালের স্বপ্নটা হুসেনের চোখে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে।