সড়ক তুমি কবে নিরাপদ হবে

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির প্রকাশিত তথ্যমতে, প্রতিদিন সড়কে গড়ে ১৭ জন নিহত হয়েছেন। তাই বর্তমানে দেশের মানুষের নিরাপত্তার প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। সংবাদপত্র হাতে নিলে চোখে পড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত ব্যক্তিদের মর্মান্তিক দুঃসংবাদ। দিন দিন সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে চলছে। প্রতিদিন সড়কে হারিয়ে যাচ্ছেন কত মানুষের আপনজন। অনেকে আবার পঙ্গু কিংবা বিকলাঙ্গ হয়ে পরিবার ও সমাজের বোঝা হিসেবে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। তাই সড়ক দুর্ঘটনা স্বাভাবিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যান্ত্রিকতার জীবনে প্রতিনিয়ত আমরা ছুটছি। কিন্তু অতিরিক্ত সড়ক দুর্ঘটনায় শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় পায়ে হেঁটে কিংবা যানবাহনে চলাফেরা রীতিমতো বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘর থেকে রাস্তায় বের হলে প্রত্যেক মানুষের মনে সড়ক দুর্ঘটনার আতঙ্ক তাড়া করে। দেশের মানুষ যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি পেয়েছে, কিন্তু এখনো নিরাপদ সড়ক পায়নি।

আমাদের দেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে প্রথম আন্দোলন করেন চলচ্চিত্র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর এক সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রীকে হারিয়েছিলেন। তারপর বিভিন্ন সময় অনেকে স্বজন হারিয়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে মিটিং, মিছিল ও সমাবেশ করেন। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের ৫ জুন মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে দুই কলেজশিক্ষার্থী বাসের ধাক্কায় মারা যাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে মাঠে নামলে বিষয়টি সবার সামনে আসে। দেশব্যাপী নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর সরকার কঠোর শাস্তির বিধানসংবলিত একটি আইন সংসদে পাস করে। দীর্ঘ চার বছর পার হলেও আইনটি এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির তথ্যমতে, ২০২১ সালে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ২৮৪ জন মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। গবেষণায় উঠে এসেছে, এসব দুর্ঘটনার প্রধাণ কারণ বেপরোয়া গতি ও বিপজ্জনক ওভারটেকিং। বর্তমান যুগ প্রতিযোগিতার যুগ। সবকিছুতে চলছে প্রতিযোগিতা। তার ধারাবাহিকতায় যানবাহনের চালকদের মধ্যে কে কত দ্রুত যেতে পারেন, তা নিয়ে সড়কে একধরনের অঘোষিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এ জন্য অনেক সময় দেখা যায়, অতিরিক্ত গতির ফলে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে যায়। আবার দুটি যানবাহন পাশাপাশি চলাচল করলে ওভারটেকিংয়ের সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়। এ জন্য চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব কমানো আবশ্যক।

তা ছাড়া চালকের অদক্ষতা, পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব, চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোন বা হেডফোন ব্যবহার কিংবা মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ মনে করা হয়। এ ক্ষেত্রে চালকদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। এ ছাড়া দেশে সড়ক অবকাঠামোর অভূতপূর্ব উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে ছোট যানবাহন—ইজিবাইক, ব্যটারিচালিত রিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ইত্যাদি। এসব ছোট যানবাহনের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা বেপরোয়াভাবে বাড়ছে।

প্রতিবছরের মতো এ বছরও সড়ক নিরাপত্তায় সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২২ অক্টোবর সারা দেশে পালিত হয়েছে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’। এবারের জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আইন মেনে সড়কে চলি, নিরাপদে ঘরে ফিরি’। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে। বাংলাদেশে সড়কপথের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫ হাজার কিলোমিটার। এসব পথে প্রতিদিন অসংখ্য যানবাহন চলাচল করে। কিন্তু অধিকাংশ যানবাহনের চালক কিংবা যাত্রীরা ট্রাফিক আইন মেনে চলেন না। যথাযথ ট্রাফিক আইন মেনে চললে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে। আবার অনেক সময় পথচারীদের অসাবধানতার কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। তাই পথচারীদের রাস্তা পার হওয়ার সময় তাড়াহুড়া না করে সতর্ক থাকতে হবে।

টেকসই আর্থসামাজিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত উন্নত যোগাযোগ এবং যুগোপযোগী পরিবহনসেবা। সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং শৃঙ্খলা আনা দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। এ দাবি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ। তাই সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে অবিলম্বে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। শুধু প্রশাসনিক উদ্যোগে সড়ক দুর্ঘটনা পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি যাত্রী ও পথচারীদের সড়কপথে আরও সচেতন হতে হবে। সর্বোপরি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সড়কে শৃঙ্খলা আনা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।

লেখক: মো. সাইফুল মিয়া, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়