শিক্ষক অবমাননা বন্ধ করো

শিক্ষকপ্রতীকী ছবি

সপ্তাহ দুয়েক ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেসব বিষয়ে সয়লাব হয়ে আছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করানো, শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করা, যা শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এটি গোটা জাতির জন্য লজ্জাজনকও বটে। ইতিহাস বলে, যুগে যুগে অতি অত্যাচারী শাসকও নতশিরে গুরুর সামনে দাঁড়িয়েছেন। গুরুকে অসম্মানের ধৃষ্টতা কেউ দেখাননি।

শিক্ষকেরা যদি কেউ অপরাধ করে থাকেন, তবে তার জন্য আইন আছে, বিভাগীয় মামলা ও শাস্তির বিধান আছে। তাই বলে সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করাতে পারে না, শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা, অপমান, অপদস্ত ও নির্যাতন করতে পারে না। শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, এটি একটি ব্রত, আদর্শ ও নৈতিক মানদণ্ড। কোনোভাবেই একে কলঙ্কিত করা যাবে না। জন অ্যাডামস শিক্ষককে ‘মারকার অব ম্যান’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘শিক্ষক হলেন জাতির আলোকবর্তিকাবাহী এবং মানবজাতির ভবিষ্যৎ রূপকার।’ শিক্ষকের সংকট থাকলে সমাজের একশ্রেণির মানুষ খুব বেশি লাভবান হয়। তাদের অন্ধকার রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি পায়। শিক্ষার সার্বিক প্রসার ও মানবিক গুণ বিকাশের গুরুদায়িত্ব শিক্ষকদের ওপর ন্যস্ত। শিক্ষা হলো মানুষের অন্তর্নিহিত বিশুদ্ধতার প্রকাশ বা বাস্তবায়ন। একজন শিক্ষক সমাজের বিবেক জাগিয়ে তোলেন, ছাত্রের সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত করেন।

তিনিই সমাজ বিনির্মাণের কারিগর। তিনিই সমাজ ও জাতির প্রয়োজনে দিশারি হিসেবে পথ দেখান এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে সর্বদা প্রস্তুত—ইতিহাস এমনটাই সাক্ষ্য দেয়। জাতি গঠন ও উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো শিক্ষা। আর শিক্ষা–সম্পর্কিত বিষয়গুলো হলো শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার পরিবেশ ইত্যাদি। তবে এ প্রসঙ্গে শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য। কেননা, শিক্ষকই হচ্ছেন শিক্ষাব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তি। আর এখনকার দিনে শিক্ষকের ওপর হামলা চালানো, তাঁদের হুমকি প্রদান, হত্যা করা ও লাঞ্ছনার ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ লজ্জা গোটা জাতির। এ দেশে অনেক শিক্ষক হত্যাসহ অনেকবার শিক্ষকদের ওপর হামলা চালানো এবং তাঁদের বারবার লাঞ্ছনার শিকার হতে হলেও এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ ঘটনারই বিচার হয়নি। ফলে অপরাধীরা এ ধরনের জঘন্য কর্মকাণ্ড ঘটাতে উৎসাহী হয়ে উঠছে, যা জাতির জন্য চরম অশনিসংকেত।

সংকট যত গভীর হয়, শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা তত বৃদ্ধি পায়। সভ্যতার শুরু থেকে আমরা দেখি, শিক্ষদের নিরলস প্রচেষ্টা শত প্রতিকুলতা ও বাধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সংকট যত গভীর হয়, শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা তত বৃদ্ধি পায়। শিক্ষক হলেন সমাজের বাতিঘর। এই বাতিঘর যখন অযত্ন–অবহেলায় বেড়ে উঠতে থাকে, তখন আমরা নিজেরাও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলি। এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির প্রভাব পড়ে আমাদের সমাজে এবং এর ভুক্তভোগী আমরাই। শিক্ষক শেখাবেন আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য, আলোর স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিতে এবং সমৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য। শিক্ষকেরা যদি নিজেদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করেন, তবে সমাজে দৃশ্যমান অনেক বিশৃঙ্খলতার সমাধান হয়ে যাবে।

মা–বাবা সন্তানকে জন্ম দেন, কিন্তু তাকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন শিক্ষক। তাই বলা হয়, গুরুদক্ষিণা ছাড়া শিক্ষা সম্পন্ন হয় না। পৃথিবীর যে দেশ শিক্ষকদের যত বেশি মর্যাদা দিয়েছে, সেই দেশ সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে তত বেশি উন্নত। শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয়, বরং একটি মহান পেশা। একজন শিক্ষক জানেন, তাঁর চলার পথ কতটা কণ্টকাকীর্ণ এবং ভবিষ্যৎ বিড়ম্বনাময়। তবু তিনি হৃদয়ের টানে এই সুকঠিন জীবিকার পথ বেছে নেন। এ জন্য তাঁকে জীবনব্যাপী সংগ্রাম করতে হলেও আদর্শচ্যুত হন না। সর্বদা ন্যায়নীতির প্রশ্নে আপসহীন। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষানিকেতন তাঁর কর্মশালা। তিনি শিক্ষার্থীর মনন, মেধা ও আত্মশক্তির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বলা যায়, একজন শিক্ষক দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং শ্রেষ্ঠ মানুষদের মধ্যে অন্যতম।

অ্যারিস্টোটল বলেছেন, ‘যিনি জানেন, তিনি করেন; যিনি বোঝেন, তিনি পড়ান।’ শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হলে শিক্ষকেরা হলেন স্নায়ুতন্ত্র, যার ভেতর দিয়ে সব সময় প্রবাহিত হয় জ্ঞানের নতুন ধারা, নতুন সভ্যতা। সভ্যতার সুচারু কারিগর হলেন শিক্ষক। একজন শিক্ষক সর্বদাই মানবিক ও নৈতিক। তিনি কখনোই ব্যবসায়িক চিন্তা করনে না। তিনি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরোধী। যিনি শিক্ষক, তাঁর পক্ষে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর কোনো রকম ক্ষতিসাধন সম্ভব হয় না। তিনি সর্বদা সৃজনশীল, অধিকারচেতা। তিনি ছাত্রদের মাধ্যমে সমাজকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন স্বপ্নের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, অন্ধকার দূর করে আলোর পথ দেখান, ছাত্রের ভেতরকে জাগিয়ে তোলেন।

শিক্ষক প্রতিনিয়তই সংগ্রাম করেন সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করতে। যাঁর কাছ থেকে ছাত্ররা সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে শেখে, বলার সাহস সঞ্চয় করে। একজন শিক্ষকই সমাজে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠা করতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষক ছাত্রদের শুধু পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন না, শুধু পরীক্ষায় পাসের জন্যই শেখানো শিক্ষকের কাজ নয়, তিনি শেখান জীবনকে জানার জন্য, জীবনকে বোঝার জন্য। শিক্ষকের সীমাহীন ত্যাগ, শ্রম ও মেধার কারণেই আমরা আজ সভ্যতার উন্নত শিখরে উন্নীত হয়েছি। শিক্ষক শ্রমজীবী থেকে শুরু সব শ্রেণির মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হন। শিক্ষক নিজেও শ্রমজীবী মানুষকে শ্রদ্ধা করেন, তেমনি ছাত্রদের শেখান শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে লড়তে ও তাদের শ্রদ্ধা করতে। শিক্ষকের আসন শুধু শ্রেণিকক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তিনি ছড়িয়ে থাকেন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। শিক্ষক না থাকলে ব্যক্তিজীবন যেমন আলোকিত হয় না, তেমনি সমাজ–সভ্যতাও আলোকিত হয় না।শিক্ষকের সংকটের কারণেই আজ যুবসমাজ বিপথগামী। শিক্ষকের সংকটের কারণেই আমাদের সমাজ, সভ্যতা ও অর্থনীতি সংকটের মুখে। প্রযুক্তির উন্নয়ন ও উৎপাদনে গতিশীলতা পাচ্ছে না।

শিক্ষক ও শিক্ষার যে সংকট চলছে, তা থেকে বরিয়ে আসতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, শিক্ষকদের সহযোগিতা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। ভালো কাজে ‘হ্যাঁ’ বলুন, খারাপ কাজকে ‘না’ বলুন। আমরা যদি আমাদের সমাজ-সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে চাই, তবে শিক্ষকের পরিসর বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শিক্ষকদের মধ্যে কোনো শ্রেণিবৈষম্য তৈরি করা যাবে না। শিক্ষকদের দক্ষতাকে নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যেও শিক্ষার সংগ্রামকে অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা আশা করি, আদর্শ শিক্ষকদের পরিসর বৃদ্ধি পাবে। পৃথিবীতে সম্ভবত বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে শিক্ষকদের বেতন সর্বনিম্ন, যেখানে শিক্ষকদের কোনো সামাজিক মর্যাদা নেই, শিক্ষকেরা প্রতিনিয়ত অবহেলিত, নিপীড়িত, শিক্ষকদের সামাজিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে। আরও একটি দুঃখজনক বিষয় হলো, এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা এখনো অনুদানের চেকের মাধ্যমে মাসিক বেতন পেয়ে থাকেন।

অনুদান কোনো সম্মানের বিষয় হতে পারে না। আমাদের দেশের কোনো সরকারই শিক্ষকদের মূল্যায়ন করেননি, বরং সরকারগুলো নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য শিক্ষকদের ব্যবহার করেছেন। এর সুযোগ নিয়ে শিক্ষার্থীরা আজ শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করাচ্ছে, অপমান–অপদস্থ করছে। অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর যদি সঠিক বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যেত, তবে আজ এ ধরনের লজ্জাজনক কাজের পুনরাবৃত্তি না–ও ঘটতে পারত।

এত কিছুর পরও আমাদের শিক্ষকেরা প্রাণপণ চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীদের কিছু শেখাতে, কিছু জানাতে। শিক্ষকের চোখেই আমরা জগৎ দেখি। মানবসভ্যতা বিনির্মাণে শিক্ষকসমাজের রয়েছে বড় অবদান। আর এ জন্যই যুগে যুগে শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা সবার ওপরে। তাঁকে সম্মান করো, যাঁর থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো। মহান সৃষ্টিকর্তাই তাঁদের মর্যাদার মুকুট পরিয়েছেন। দেশ ও জাতির স্বার্থেই শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। আজকের বাজারমূল্যে শিক্ষকদের অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো। শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল নামের একটি মুলা ঝুলছে ১৫ বছর ধরে।

  • সুধীর বরণ মাঝি, শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, হাইমচর, চাঁদপুর

  • নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]