সংকটের মুখে ঘড়ির ‘ডাক্তার’ রবিন দাশের পেশা
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের জীবনযাপনে আসছে পরিবর্তন। প্রযুক্তির উৎকর্ষে মানুষ আধুনিকতার ছোঁয়া পাচ্ছে। মানুষ দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এর মধ্য দিয়ে কেউ কেউ যুগের চাহিদা অনুযায়ী পেশা পরিবর্তন করছে; আবার কেউ কেউ ধ্যান, জ্ঞান, নেশায় আগলে রাখছে নিজের পেশাকে। এমনই একজন মানুষ সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খেশরা গ্রামের রবিন দাশ (৬৯)। যিনি দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ঘড়ি মেরামতের কাজ করে আসছেন। এলাকায় রবিন দাশ ‘ঘড়ির ডাক্তার’ নামে বেশ পরিচিত।
বাড়ি খেশরা গ্রামে হলেও পার্শ্ববর্তী পাইকগাছার কাটিপাড়া বাজারে তাঁর ঘড়ি মেরামতের দোকান। ঠিক দোকান তা–ও বলা যায় না। একটি দোকানের বারান্দায় কিছুটা চৌকো সাইজের বাক্সের মতো দেখতে, চারপাশে কাচের ঘেরাটোপ দেওয়া। মাথার ওপর শক্ত কিছু পুরোনো কাগজ দিয়ে ছাদ বানানো। তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা পুরোনো দেয়ালঘড়ি, হাতঘড়ির কিছু যন্ত্রাংশ আর ঘড়ি মেরামতের জন্য কিছু যন্ত্রপাতি। এগুলোর মধ্যেই রয়েছে তাঁর জীবন ও জীবিকা।
সময় মেরামতের কাজ করা রবিন দাশ এখন আর ভালো নেই। বয়সের ভারে অনেকটা ন্যুব্জ। শরীরে বেঁধেছে বার্ধক্যজনিত নানা রোগ। শরীরের এই বার্ধক্যের ছায়া এসে পড়েছে তার ওই দোকানের বাক্সের ওপর, যা অনেকটা দৃশ্যমান। চোখে আগের মতো দেখতেও পায় না। তাই উত্তল লেন্স লাগানো বিবর্ধক চশমা বানিয়ে নিয়েছে, যাতে ঘড়ির যন্ত্রণাংশগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে দেখা যায়।
কিন্তু ঘড়ি মেরামতের এই কাজে আগের মতো আর পয়সা নেই। কারণ, খুব কম মানুষই এখন হাতঘড়ি ব্যবহার করে। তবে হ্যাঁ, দেয়ালঘড়ির একটা প্রচলন এখনো গ্রামাঞ্চলে রয়েছে, যা মেরামত করতে আসে অনেকে। তবে সেই সংখ্যাও হাতে গোনা। কয়েক বছর হচ্ছে এক বেলা করে দোকান খোলেন তিনি। তাতে যা রোজগার হয়, তা দিয়েই দুজনের ছোট সংসার হেসেখেলে চলে যায় রবিন দাশের।
দেয়ালঘড়ি ঠিক করতে আসা মো. রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘বাড়ির ঘড়িটা অনেক দিন ধরে নষ্ট। সময় দেখতে সব সময় তো কাছে আর মুঠোফোন থাকে না। তাই ভাবলাম ঘড়িটা রবিন দাদুর কাছ থেকে মেরামত করে নিয়ে যাই। তাই ঘড়িটা নিয়ে এলাম তাঁর কাছে। আসলে মুঠোফোনে সময় দেখার কারণে ঘড়ির সেই স্বর্ণযুগ এখন আর নেই। তবে দু–একজন যাঁরা ঘড়ি ব্যবহার করেন, তাঁদের ঘড়ির সমস্যা হলে মেরামতের জন্য রবিন দাদুদের বেশ প্রয়োজন আছে আমাদের সমাজে।’
বেশ কিছু সময় নব্বই দশকের গল্প শুনাচ্ছিলেন ঘড়ির ডাক্তার রবিন দাশ। তিনি বলছিলেন, নব্বই দশকে ঘড়ির রমরমা একটা বাজার ছিল। বন্ধু, আত্মীয়স্বজন বা বিয়েতে ঘড়ি উপহায় দেওয়ার একটা প্রচলন ছিল। যে উপহার বেশ মূল্যবান হিসেবে ধরা হতো। একটি সময় গিয়ে মুঠোফোন আসার পর থেকে ঘড়ির ব্যবহারে ভাটা পড়ে। সঙ্গে ঘড়ি মেরামতের সঙ্গে যুক্ত পেশাতেও সংকট দেখা দেয়। নতুন কাজ শেখার আর বয়স না থাকায় এই পেশাতে আজও পড়ে আছেন তিনি। তবে এখনো অনেক বয়স্ক মানুষ হাতঘড়ি ব্যবহার করেন এবং ঘড়ির যেকোনো সমস্যায় তাঁর কাছে মেরামত করতে আসেন বলে জানান তিনি।