পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে অগ্রগামী নারীদের কথা বিশ্বমঞ্চে
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার জেসমিন বেগম। পানিতে ডোবা থেকে নিজের এলাকার শিশুদের রক্ষার জন্য তাঁরই বাড়ির একটি ঘর দান করেছেন কমিউনিটি ডে কেয়ার বা ‘আঁচল ঘর’ হিসেবে ব্যবহারের জন্য। সেই ঘরেই সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত পাঁচ বছরের কম বয়সী ২০ থেকে ২৫টি শিশুকে দেখাশোনা করেন তিনি। সে জন্যই এলাকায় জেসমিনের পরিচয় একজন ‘আঁচল মা’ হিসেবে। তাঁকে সহায়তা করার জন্য সঙ্গে রয়েছেন একজন সহকারী। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশে (সিআইপিআরবি) কাজের সূত্রে তিনি শিখেছেন, কীভাবে কার্ডিও পালমুনারি রিসাসিটেশন বা সিপিআর দিতে হয়। আর এ কাজ তাঁকে দিয়েছে এক দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। পড়শির এক শিশুকে পানি থেকে তুলে তাঁকে ডাকেন এলাকার লোকজন। কারণ তাঁরা জানেন, এই এলাকায় জেসমিনই একমাত্র, যে জানেন পানিতে কেউ ডুবে গেলে তাঁকে উদ্ধারের পর কী প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হয়। সেদিন তাঁরই দেওয়া সিপিআরে বেঁচে ওঠে শিশুটি।
পটুয়াখালীর আরেক কিশোরী, আরিফা আক্তার। তিন মৌসুম ধরে সে তার এলাকার শিশুদের সাঁতার শিখিয়ে আসছে। তারই বাড়ির পুকুরে বিশেষ কায়দায় মাচা তৈরি করে তাতে প্রতি মৌসুমে দেড় শ থেকে দুই শ শিশুকে সাঁতার শিখিয়ে আসছে সে। এখন পর্যন্ত সাঁতার শিখিয়েছে প্রায় ছয় শ শিশুকে। এ বছর যে শ দুয়েক শিশুকে সাঁতার শিখিয়েছে, তাদের মধ্যে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুও ছিল। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে যাঁদের ধারণা আছে তাঁরা জানেন, কত কত উন্মুক্ত পানির আধার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। প্রতিবন্ধী শিশুদের পানিতে ডোবার ভয় সেখানে আরও বেশি। তাই আরিফার কাছে ওই প্রতিবন্ধী শিশুটির মায়ের কৃতজ্ঞতা যেন একটু বেশিই। আরিফার পুরো পরিবারই গ্রামে পরিচিত হয়ে উঠেছে সাঁতার শেখানো পরিবার হিসেবে।
বয়স ৪০-এর কাছাকাছি শামসুন্নাহারের। সিআইপিআরবিতে তিনি কর্মরত প্রায় এক যুগ ধরে। তাঁর কাজের জায়গা, মানুষকে পানিতে ডোবা রোধে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেওয়া। ২০১২ সাল থেকে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এ পর্যন্ত তিনি সারা দেশে ১৯ হাজারের বেশি মানুষকে এই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এই কাজে তাঁর সমকক্ষ পুরো দেশে আরেকজন আছে কি না সন্দেহ। ওপরে যে আরিফা আর জেসমিন বেগমের নাম বলা হলো, তাঁরাও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এই শামসুন্নাহারের কাছ থেকেই। ক্যারিয়ারের শুরুতে শামসুন্নাহারও একজনের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন সিপিআর দিয়ে।
জেসমিন, আরিফা আর শামসুন্নাহার—তিনজন যেন বাংলার হাজারো সাহসী নারীরই প্রতিচ্ছবি। পেশায় যেমন তাঁরা অনন্য, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতায়ও তাঁরা তাঁদের নাম সমুজ্জ্বল করেছেন। তাঁরা কেউই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মাপকাঠিতে উচ্চশিক্ষিত নন, কয়েক বছর আগেও তাঁরা ছিলেন কেবলই নারী, কিন্তু এখন তাঁরা অনন্য। তাঁদের জীবনের অর্জন নিয়েই আমি গিয়েছিলাম ইংল্যান্ডের দুই শহর লন্ডন আর পুল-এ।
ইউনাইটেড কিংডমের এক দ্বিশতবর্ষী প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউশন, আরএনএল আই এবারের নারী দিবসকে উপলক্ষ করে আয়োজন করে এক সেমিনার আর ‘উইমেন ইন সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ’ নামের এক কনফারেন্সে। এই দুই আয়োজনে তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র হিসেবে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানে আগত শত শত অতিথিকে আমি শুনিয়েছি এই তিন সাহসী নারীর কথা। সাহস-ই তাঁদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে একজন বলিষ্ঠ মুখপাত্র হিসেবে। তাঁরা আজ কেবল অর্থ উপার্জনই করছেন না, অবদান রাখছেন সমাজ বিনির্মাণে। তাঁরা অদম্য মানসিক শক্তিতে বলীয়ান। তাঁরাই পৃথিবীতে বাংলার অদম্য নারীদের প্রতিচ্ছবি।
নাহিদ আখতার: কমিউনিকেশনস ম্যানেজার, সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ