আড়ালের অবরোহণ

ছবি: প্রথম আলো

এই যে দেশে এত বড় একটা লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেল, কত পরিবার সন্তান হারাল, কেউ কেউ নিঃস্ব হয়ে গেল, এখন তারা কেমন আছে? কেমন যাচ্ছে এখন তাদের যাপনচিত্র? গরহাজির স্বর্গগত মানুষটিকে ছাড়া নির্ঘুম রজনীর সংখ্যা দীর্ঘ থেকে কি এতই দীর্ঘতর হচ্ছে, যে গুনতে ব্যর্থ। কখনো ঘুমিয়ে যদি পড়েও, মাঝরাত্তিরে তীব্র হাহাকারে ঘুম ভেঙে যায়? হতাশার গভীরতম সময়ের সাক্ষী হয়ে ভগ্নহৃদয়ে ভর দিয়ে কি ভোরের সূর্য দেখে?

অতিমাত্রিক মানসিক যন্ত্রণায় প্রতিদিন একবার করে মরছে। যত দিন বাঁচবে, তত দিন মরবে। ছুরির ফলার চেয়ে ধারালো মনযন্ত্রণা ভোগ করে পৃথিবীতে বেঁচে থাকছে। স্বজন হারানোর বেদনা অন্তরে ধারণ করে প্রতিক্ষণ মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার ইচ্ছা নিয়েও যখন সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মে চালিয়ে যেতে হয়। ভেতরটা জ্বলতে থাকলেও ঠান্ডা মাথায় জাগতিক আচার পালন করতে হয়। চেনা পৃথিবীর অচেনা আচারে বাক্‌ হারিয়েও সবাক থাকতে হয়।

অসাবধানে সন্তানের পছন্দের খাবারটা হঠাৎ মায়ের সামনে চলে এলে সেই খাবার গলা দিয়ে না নেমে ভেতরের চাপা অনুভূতি গলার কাছে তীক্ষ্ণ চাপ বাড়ায়। সেই অনুভূতির তলে অদৃশ্য হয়ে জননীর নিশ্বাস ভারী হয়ে যায়। বেঁচে থাকাটা তিতা লাগে। সুচের মতো বিদ্ধ করে চলে মনের ভেতর। বাইরে থেকে তা বোঝা যায় না। ডুবে থাকে রক্ত–মাংসের খোলস লাগানো মানুষ নামের রহস্যময় প্রাণীটির অন্দরে। সারিয়ে তোলা যায় না। শুধু ভেতরের জগৎটা থমকে যায়। তাদের এই অসহনীয় অনুভূতির খোঁজ পৃথিবী রাখে না। বোকা মানবসন্তান, তবু কান পেতে শোনে... সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেছে তাদের শোকে? স্থিরচিত্র হয়ে গেছে সব?

সময় কি থেমে গেছে?

না, না তো, থামে না কিছুই। স্বার্থপর ধরণি আপন বলয় ছেড়ে অন্য কারও আপন হয় না।

আবার যখন প্রকৃতিতে ফাগুন আসবে, দখিনের খোলা জানালা গলে, মৃদুমন্দ বাতাসে দেহ–মন জুড়িয়ে যাবে, সুখের সময় কাটবে, তখন কি এই এতগুলো নির্ঘুম রাত কাটানো মানবসন্তানের এই বিষাক্ত মুহূর্তগুলো স্মৃতিতে ভেসে উঠবে না? তখন কি এই হারানোর যন্ত্রণা ভুলে যাবে? বিপন্ন ক্ষতগুলো ভুলে আহ্লাদের আহ্বানে আন্দোলিত হতে পারবে? স্রষ্টার ধরণি যে এই, এত এত বর্ণছটার রং–রূপ নিয়ে হাত মেলে আছে, ছুঁতে পারবে আবার?

লেখক

জানি, ভুলবে না, তা বলা যায় না। বেড়িতে বাঁধা দোপেয়ে প্রাণী.. কতই তার ক্ষমতা... আঘাত যতই বেগবান হোক, ভুলে যেতে হয়। ভুলে যাওয়ার জন্যই এই বেঁচে থাকা।

যে প্রকৃতির অনাচার সাগ্রহে নির্ঘুম রাতের সারি সারি সংখ্যা সাজায়, বেঁচে থাকার সবটুকু ইচ্ছা কেড়ে নেয়, একসময় সেই প্রকৃতির আলো–হাওয়াই জীবনের তাগিদে আবার ঘুমপাড়ানি হাওয়ার স্পর্শে পুরোনো পার্থিব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়।

লেখক: নুসরাত রহমান, শিক্ষার্থী, কবি নজরুল সরকারি কলেজ

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]