চুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু: চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক নিরাপদ করতে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি
কাপ্তাই সড়কে যেন মৃত্যুর মিছিল নেমে আসে প্রায় প্রতিবছর। এটা তো আর নতুন কিছু নয়। গাড়ি বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলন করে মানুষের দুর্গতি বাড়ানোর হেতু কী, বুঝি না। চুয়েটের দুটি তাজা প্রাণ বড় বাসযানেরধাক্কায় চলে গেল। আসলে আদৌ কি প্রকৃত ঘটনা আমরা জানি? ঘটনাস্থলে কার কেমন দোষ ছিল? সেদিন চুয়েটের ছেলেগুলো বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালাল কিনা, নাকি বাস ড্রাইভার ইচ্ছা করেই ধাক্কা দিল, তা কর্তৃপক্ষের বের করে আনতে হবে। এভাবে আন্দোলনের তোপে গাড়ি বন্ধ রাখলে দূরপাল্লার মানুষজন প্রাত্যহিক প্রয়োজনে যাতায়াত করবে কী করে?
তা ছাড়া চট্টগ্রাম শহর থেকে নিয়মিত চাকরি করছেন ও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সেবা দিয়ে যাচ্ছেন অনেক মানুষ। গাড়ি বন্ধ করে দিয়ে প্রাত্যহিক কাজে বাধা প্রদান উচিত নয়। একবার ভাবুন তো কী যে কষ্ট হচ্ছে ঐ সব মানুষের, যাঁরা নিয়মিত শহর থেকে গিয়ে কাজ করেন এবং দেশের সেবায় নিয়োজিত? এই ফাঁকে সিএনজি চালকেরা ‘ডাকাত’ হয়ে উঠেছেন। তাঁরা এখন সুযোগ পেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া হেঁকে নিচ্ছেন। মানুষকে এতো কষ্ট দিয়ে কার কী লাভ হচ্ছে। সমস্যার শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে হবে, অন্যের ক্ষতি, গাড়ি পুড়িয়ে তা কোনোমতে নয়। এতে ভালো-মন্দের আর কী তফাৎ রইল? তা ছাড়া এতো গরমে চুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও জনগণও প্রতিবাদের রোষানলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিতে আছে। আমরা অবশ্যই চাই প্রকৃত দোষীর বিচার হোক এবং নিহত ব্যক্তিদের যথাযথ আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক ও আহত ছেলেটির চিকিৎসার দায়িত্ব নিক বাস মলিক ও রাষ্ট্র।
কাপ্তাই সড়কের সেলিমা জামান কলেজের টেক বা বাঁকে প্রায়ই গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটে। বহু প্রাণ গেছে ঐ বাঁকটায়। প্রশ্ন হলো, এমন ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকে ট্রাফিক পুলিশ নিয়মিত থাকে না কী কারণে? অথচ দেশে এত পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে বিভিন্ন খাতে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়েছে নিরাপদ সড়ক করার উপায়গুলো কী কী হতে পারে এবং সঙ্গে আপনাদের তো অনেক পথ জানা আছেই। কাপ্তাই ও অন্যান্য সড়কপথ নিরাপদ করতে যা যা আবশ্যকীয় দরকার, তা হলো—
১. কাপ্তাই সড়ক বর্তমানে চার লেনের সড়কে উন্নীত করতে হবে
২. সড়কের আশেপাশে অবৈধ দখলদারি জায়গা, দোকান উচ্ছেদ করতে হবে
৩. রাস্তার জন্য বরাদ্দ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গাগুলো উদ্ধার করতে হবে
৪. প্রয়োজনে সড়কের প্রতিটি বাঁকে, ব্যস্ততম এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ ও টহল বাড়ানো অতি আবশ্যক
৫. সড়ক বিভাজক তৈরি করতে হবে এবং সবুজায়ন করতে হবে
৬. রিকশা, মোটর সাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা ইত্যাদি ছোট গাড়ি চলাচলের আলাদা রোড পাশাপাশি করে দিতে হবে, যাতে বড় গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতার পাল্লায় পড়ে ওভারটেক না করে
৭. রাস্তায় প্রচুর গতিরোধক, ব্যস্ততম ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পদচারি সেতু করে দিতে হবে
৮. চট্টগ্রাম শহর হতে পার্বত্য এলাকা পর্যন্ত ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা এখন সময়ের দাবি। ট্রেনব্যবস্থা চালু হলে কাপ্তাই সড়কের ওপর অনেকটাই চাপ কমবে
৯. সড়কের আশপাশ, মহল্লায় সড়কপথে নিরাপদে চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় উপদেশমূলক বার্তা জনগণকে সচেতন করতে প্রচুর পোস্টারিং করতে হবে
১০. সড়কের দুই ধারে ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা রাখা আবশ্যক, যাতে বর্ষাকালে পানি না জমে
১১. কাপ্তাই সড়ক যেন একটি ভূতের সড়ক, যা রাত নামলে বোঝা যায়। ব্যবসা–বাণিজ্যের এলাকা ছাড়া পুরো মাইলের পর মাইল সড়কটি অন্ধকারে ডুবে থাকে। কোনো লাইটিংয়ের ব্যবস্থা তেমন নেই। এ জন্য চুরি–ডাকাতি বেড়ে গেছে। আর দুর্ঘটনা ঘটা খুব স্বাভাবিক। এসব দিকে নজর দেওয়া জরুরি
১৩. আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, গ্রাম পুলিশ—তাদেরও যথাযথ কাজে লাগাতে হবে। প্রয়োজনে শিফটিং ডিউটি দিয়ে রাস্তার নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে
১৪. দক্ষ গাড়িচালক তৈরিতে উপজেলায় উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। অবৈধ ভাঙাচোরা গাড়ি অচিরেই রাস্তা থেকে উচ্ছেদ করতে হবে।
১৫. এমন দীর্ঘ পথের সড়কে ছোট গাড়ি, সিএনজিচালিত যানবাহন কিংবা অন্যান্য গাড়িতে যাতায়াত আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার কাঙ্খিত জায়গায় সঠিক সময়ে পৌঁছাতে। তাই রিজার্ভ ও লোকাল বাস সার্ভিস চালু করে বাকি ছোট গাড়িগুলো এই কাপ্তাই সড়কে চলাচল নিষিদ্ধ করা উচিত।
এসব কাজ যদি সরকার করে দেয়, তাহলে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সড়ক কেন প্রায় প্রতিটি সড়কে জানমালের নিরাপত্তা বিধান হওয়ার সুযোগ বাড়বে।
*লেখক: পারভীন আকতার, শিক্ষক
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]