৩৬৫টি জাতীয়করণকৃত কলেজে শিক্ষকসংকট ও বঞ্চনা—নিয়মিত পাঠদান ব্যাহত

ফাইল ছবি

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাত বহুদিন ধরেই এক জটিল বাস্তবতার ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে। নানা সংস্কার, প্রশাসনিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ভিড়ে সবচেয়ে আলোচিত হয়ে উঠেছে কলেজ জাতীয়করণ ও শিক্ষক আত্তীকরণের প্রশ্ন। সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যমে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট যে শিক্ষকদের অধিকার, মর্যাদা ও সুযোগ–সুবিধা নিয়ে একধরনের নীতি–সংঘাত তৈরি হয়েছে। একদিকে শিক্ষকদের ন্যায়সংগত দাবি, অন্যদিকে সরকারি নীতিমালা ও প্রশাসনিক জটিলতা—এই দ্বন্দ্ব উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে এক বড় প্রতিবন্ধকতায় পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশে এখনো উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কলেজ বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত হয়। এসব কলেজে কর্মরত শিক্ষকেরা সরকারি কলেজের শিক্ষকদের মতো বেতন–ভাতা, পেনশন, চিকিৎসার সুবিধা ও পদোন্নতির সুযোগ পান না। ফলে তাঁদের মধ্যে জাতীয়করণের দাবি বহু বছর ধরে প্রবল হয়ে উঠেছে। জাতীয়করণ মানে হলো, কোনো বেসরকারি কলেজকে সরকারি বাজেট ও প্রশাসনিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করা। এতে কলেজের শিক্ষকেরা সরকারি চাকরির নিয়মে বেতনকাঠামো, পেনশন ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করতে পারেন। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীরাও সরকারি সুযোগ–সুবিধা পায়। তাই জাতীয়করণকে কেবল শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদার প্রশ্ন হিসেবে দেখা যায় না; এটি শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য একটি পদক্ষেপ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের জুলাইয়ে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার ২৭০টি কলেজকে সরকারি ঘোষণা করে এবং পরবর্তী সময় আরও বেশ কয়েকটিসহ মোট ৩৬৫টি কলেজ সরকারীকরণের আওতায় আনা হয়। এসব সরকারিকৃত কলেজগুলোর শিক্ষক ও কর্মচারীরা বিভিন্ন যাচাই–বাছাই ও হয়রানির শিকার হয়ে অবশেষে ২০১৮ সালের শেষ দিকে অ্যাডহক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। উল্লেখ্য যে এসব কলেজের অনেক শিক্ষক–কর্মচারী এখনো নিয়োগের জন্য বিভিন্ন দপ্তরের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]

এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে জটিল ইস্যু হলো অ্যাডহক শিক্ষকদের অবস্থান। বহু শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে অ্যাডহক ভিত্তিতে কর্মরত আছেন। তাঁদের দাবি, কলেজ জাতীয়করণের ঘোষণার তারিখ থেকেই নিয়মিতকরণ কার্যকর করতে হবে। একই প্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর পাঠদান করা সত্ত্বেও তাঁরা এখনো ‘অস্থায়ী’ পরিচয়ে কাজ করছেন, যা শিক্ষকদের জন্য আর্থিক ও মানসিক অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। অন্যদিকে সরকারের নীতিমালায় সময়–সময় পরিবর্তন আসায় অনেকে স্থায়ী নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর ফলে পদোন্নতি, পেনশন বা আর্থিক সুবিধার সুযোগ হারিয়ে তাঁরা হতাশ হয়ে পড়ছেন।

এ ছাড়া জাতীয়করণকৃত কলেজের শিক্ষকদের জন্য আত্তীকরণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হলেও তা বাস্তবে নানা বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। ২০০০ সালের বিধিমালায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল, আত্তীকৃত শিক্ষকেরা শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত হবেন। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের একটি অংশের বিরোধিতা, আন্দোলন ও রিট মামলার কারণে ২০১৮ সালের বিধিমালায় তাঁদের নন–ক্যাডার ঘোষণা করা হয়। একই কলেজে একই দায়িত্ব পালন করেও আত্তীকৃত শিক্ষকেরা সরকারি ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমান মর্যাদা ও সুবিধা পান না। ফলে শিক্ষকসমাজের ভেতরে একধরনের বিভাজন তৈরি হয়।

এই বৈষম্যের অবসান চেয়ে শিক্ষকেরা বিভিন্ন সময়ে একাধিক দাবি তুলেছেন। আত্তীকৃত শিক্ষক–কর্মচারীরা ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে আত্তীকরণের সময় পাওয়া বেতন গ্রেড অক্ষুণ্ন রাখা, ইফেকটিভ সার্ভিস গণনা করে জ্যেষ্ঠতা প্রদান, পাঁচ বছর পূর্ণ হলে পদোন্নতি, চাকরির পুরো সময়কে সরকারি চাকরির অংশ হিসেবে গণনা করা এবং পদোন্নতির স্বাভাবিক সোপান নিশ্চিত করা। অন্যদিকে সরকারিকৃত কলেজশিক্ষকদের সংগঠন (সকশিস)–এর শিক্ষকেরা সংবাদ সম্মেলন করে আট দফা দাবি জানিয়েছেন। এর মধ্যে ছিল জাতীয়করণের তারিখ থেকে নিয়মিতকরণ, অবসরপ্রাপ্তদের শতভাগ আর্থিক সুবিধা প্রদান, দ্রুত স্থায়ীকরণ ও বঞ্চনাকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। সব দাবির মধ্যেই স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে চাকরির নিরাপত্তা, পদোন্নতি ও আর্থিক অধিকার নিশ্চিত করার প্রশ্ন।

এই জটিলতার পেছনে মূল দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে ২০০০ সালের বিধিমালা ও ২০১৮ সালের বিধিমালার পার্থক্য। রাষ্ট্রপতি প্রণীত ২০০০ সালের বিধিমালায় আত্তীকৃত শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্ত করার বিধান ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে শিক্ষা ক্যাডারের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের বিধিমালায় পরিবর্তন আনা হয় এবং তাঁদের নন–ক্যাডার ঘোষণা করা হয়। শিক্ষকেরা মনে করেন, তাঁরা রাষ্ট্রপতির বিধি অনুযায়ী ক্যাডারভুক্ত হওয়ার যোগ্য হলেও মাউশির কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ ও অনীহার কারণে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। একই সঙ্গে প্রশাসনের ভেতর দ্বৈত বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। কেউ বলছেন বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন, আবার কেউ দাবি করছেন কোনো মামলা নেই। এই দ্বন্দ্ব শিক্ষকদের আস্থাহীনতা আরও বাড়াচ্ছে।

সম্প্রতি সরকার ‘সরকারিকৃত কলেজ শিক্ষক ও কর্মচারী আত্তীকরণ বিধিমালা, ২০২৫’ প্রকাশ করেছে। যদিও এতে সংজ্ঞার স্বচ্ছতা, নিয়োগ কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ ও ভবিষ্যৎ প্রযোজ্যতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার মতো কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে, তবুও নানা সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অস্থায়ী নিয়োগ, স্থায়ীকরণ প্রক্রিয়ার জটিলতা, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অস্পষ্টতা, কার্যকর চাকরির মেয়াদ ও পূর্ববর্তী চাকরির হিসাব গণনা নিয়ে অস্পষ্টতা। অনেক শিক্ষক দীর্ঘদিন অস্থায়ী পদে থেকে যাচ্ছেন এবং অবসরের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেও স্থায়ী হওয়ার নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না। আবার নিয়োগ কর্তৃপক্ষকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হলেও বাস্তবে মাউশি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মধ্যে দ্বন্দ্ব থেকে যাচ্ছে। এতে পদোন্নতি, বদলি ও চাকরি স্থায়ীকরণের মতো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে।

শিক্ষকদের আরেকটি বড় অভিযোগ হলো, বেতন গ্রেডের বৈষম্য। আত্তীকরণের সময় সব প্রভাষককে নবম গ্রেডে রাখা হয়েছে, যেখানে কেউ কেউ আগে থেকেই ষষ্ঠ বা সপ্তম গ্রেডে ছিলেন। এটি তাঁদের কাছে মর্যাদাহানিকর মনে হচ্ছে, বিশেষ করে যাঁরা ৫০ বছরের বেশি বয়সে এসে নতুন করে প্রারম্ভিক গ্রেডে নেমে গেছেন। একইভাবে লাইব্রেরিয়ান, প্রদর্শক ও ল্যাব সহকারীদের পদ অবনমিত হওয়ায় তাঁদের চাকরিজীবনও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া পূর্ববর্তী বেসরকারি চাকরির সময়কে পুরোপুরি সরকারি চাকরির অংশ হিসেবে গণনা করা হয়নি, পদোন্নতি বা বদলির কোনো সুস্পষ্ট সোপান বা কাঠামো না করার ফলে শিক্ষকেরা প্রারম্ভিক পদে আটকে থাকছেন এবং অবসরে যাচ্ছেন। এতে বদলি, পদোন্নতি, চাকরি স্থায়ীকরণ ও পেনশনের মতো বিষয়ে শিক্ষকেরা তাঁদের অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন এবং বদলি, জ্যেষ্ঠতা ও পেনশনের মতো মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকে।

অন্যদিকে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা মনে করেন, আত্তীকৃত শিক্ষকেরা ক্যাডারভুক্ত হলে ক্যাডারের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে। এ জন্য তাঁরা বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন, ধর্মঘট ও রিট করেছেন। এর ফলেই ২০১৮ সালের বিধিমালা পরিবর্তন হয় এবং আত্তীকৃত শিক্ষকদের নন–ক্যাডার ঘোষণা করা হয়। ফলে শিক্ষকসমাজের মধ্যে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। একদিকে সরকারি ক্যাডার কর্মকর্তা, অন্যদিকে আত্তীকৃত শিক্ষকেরা। এই বিভাজন উচ্চশিক্ষার কাঠামোকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়ন করতে গেলে সরকারের জন্য বড় অঙ্কের অর্থনৈতিক দায় তৈরি হবে। নিয়মিতকরণ, পদোন্নতি ও পেনশনের সুবিধা দিতে গেলে বাজেটে অতিরিক্ত চাপ পড়বে। অন্যদিকে প্রশাসনিক আমলাতন্ত্রও এ সমস্যাকে জটিল করছে। মাউশি কর্মকর্তাদের হয়রানি, ফাইল আটকে রাখা ও বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে শিক্ষকেরা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। যেহেতু অতীতে এ কর্মকর্তারা আত্তীকরণের বিরোধিতা করেছেন, তাই এখন তাঁদের হাতে সুবিধা দেওয়ার দায়িত্ব পড়ায় ন্যায্য বিচার পাওয়া আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে শিক্ষার মানে। শিক্ষকেরা যখন আর্থিক ও পেশাগত অনিশ্চয়তায় থাকেন, তখন তাঁদের মনোযোগ শ্রেণিকক্ষে থাকে না। এর প্রভাব সরাসরি পড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর। জাতীয়করণ ও নিয়মিতকরণ কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে শিক্ষকেরা আর্থিক নিরাপত্তা ও পেশাগত মর্যাদা পাবেন, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে শিক্ষাদানে। দীর্ঘ মেয়াদে এটি দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে সহায়ক হবে।

সুতরাং কলেজ জাতীয়করণ ও শিক্ষক আত্তীকরণের প্রশ্ন এলে কেবল একটি প্রশাসনিক বিষয় নয়; বরং শিক্ষা খাতের ভবিষ্যতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু নীতিগত অস্পষ্টতা, প্রশাসনিক অনীহা ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে সমস্যার সমাধান দীর্ঘদিন ঝুলে আছে। এর ফলে শিক্ষকেরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, শিক্ষার্থীরাও মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ ছাড়া ২০১৬ সাল থেকে এসব কলেজে নতুন শিক্ষক নিয়োগ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে, ‘এমবার্গো’ জারি করার কারণে। ফলে শিক্ষক অবসরে যাওয়া বা মৃত্যুর মাধ্যমে বহু পদ শূন্য হয়ে গেলেও নতুন নিয়োগ হচ্ছে না। কলেজগুলো বাধ্য হয়ে অতিথি শিক্ষক দিয়ে ক্লাস চালালেও তাঁরা নিয়মিত শিক্ষকদের মতো দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন অনুযায়ী ক্লাস নিতে পারেন না বা শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত ক্লাসের সংখ্যা কমিয়ে দিতে হয়। এর ফলে জাতীয়করণ–সংক্রান্ত প্রশাসনিক জটিলতা সরাসরি শিক্ষার গুণগত মানকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে।

এখন সবচেয়ে জরুরি হলো নীতিগত স্বচ্ছতা আনা, প্রশাসনিক জটিলতা দূর করা এবং ধাপে ধাপে শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়ন করা। কারণ, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ মানে ভবিষ্যতের মানবসম্পদে বিনিয়োগ। কিন্তু যদি শিক্ষকসমাজ মর্যাদা ও নিরাপত্তা না পায়, তবে উচ্চশিক্ষার উন্নয়ন টেকসই হওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আজকের এই জটিলতার সমাধানের ওপর। শিক্ষকসমাজকে মর্যাদা দেওয়া মানে আসলে জাতির ভবিষ্যৎকে মর্যাদা দেওয়া।

*লেখক: শুভাশীষ দাশ, প্রভাষক, ইংরেজি, সরকারি ইকবাল মেমোরিয়াল কলেজ, ফেনী [email protected]