ঐতিহ্যের টাঙ্গাইল শাড়ি ও জিআই স্বত্ব-বিতর্ক
বর্তমান সময়ে গণমানুষের মতামত প্রকাশের অন্যতম একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যখন যে ব্যাপার নিয়ে খুব বেশি চর্চা হয়, তখন সে ব্যাপারকে মোটামুটি ‘টক অব দ্য টাউন’ বলা যায়। তাই মূলধারার গণমাধ্যমের থেকে কখনো কখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দেখেই কোনো একটি ইস্যুতে মানুষের প্রতিক্রিয়া সহজেই অনুধাবন করা যায়; সহজভাবে বললে ‘পালস’ বোঝা যায়! সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তেমনই একটি বিষয় বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ির উৎস পশ্চিমবঙ্গ বলে দাবি করেছে ভারত। দেশটির সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এমনই একটি দাবি করা হয় এবং তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে পোস্টও করা হয়েছে। এর পর থেকেই আলোচনার ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বাংলাদেশের একটি নিজস্ব পণ্যের জিআই স্বত্ব ভারত পাওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাংলাদেশিরা।
ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, টাঙ্গাইল শাড়ির পাশাপাশি সুন্দরবনের মধুরও জিআই স্বত্ব পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বতন্ত্র একটি ভৌগোলিক পণ্যের স্বত্বাধিকারী আরেকটি দেশ কীভাবে হয়? ঐতিহাসিকভাবে আসলে টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতীয় পণ্য হওয়ার কি আদৌ কোনো সুযোগ আছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে কিছুটা ইতিহাসের পাঠ নিতে হবে। আমি জন্মসূত্রে টাঙ্গাইলের অধিবাসী; একই সঙ্গে ইতিহাসের একজন ছাত্র। তাই এ ব্যাপারে একটু আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।
তাঁতশিল্প বাংলাদেশের অন্যতম পুরোনো কুটির শিল্প। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তারই ঐতিহ্য বহন করে। টাঙ্গাইলের দক্ষ কারিগরেরা তাঁদের বংশপরম্পরায় তৈরি করছেন এ শাড়ি। ব্রিটিশ আমল থেকেই এই শাড়ি বুননের ইতিহাস। ইবনে বতুতার ‘কিতাবুল রেহালা’ নামক ভ্রমণকাহিনিতে টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পের উল্লেখ রয়েছে। হিউয়েন সাংও তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির কথা উল্লেখ করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে টাঙ্গাইল তাঁতশিল্পের ব্যাপ্তি প্রসারিত হয়। তাই জেলার নামেই এর নামকরণ করা হয়েছে ‘টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি’। বাংলাদেশের অনেক তাঁতি সম্প্রদায় টাঙ্গাইল শাড়ির বুননকর্মে জড়িত। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো তাঁতি সম্প্রদায় হচ্ছে টাঙ্গাইলের পাথরাইলের বসাক সম্প্রদায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতিরা মূলত ঐতিহ্যবাহী মসলিন তাঁতশিল্পীদের বংশধর। শুরুতে তাঁরা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে এসে তাঁতের কাজ শুরু করেন। আবহাওয়া ভালো না হওয়ায় সেখান থেকে চলে আসেন রাজশাহীতে। সেখানেও আবহাওয়া প্রতিকূল দেখে তাঁরা দুভাগে ভাগ হয়ে একদল চলে আসে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর এবং আরেক দল চলে যায় ঢাকার ধামরাইয়ে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁরা দেলদুয়ার, সন্তোষ ও ঘ্রিন্দা এলাকার জমিদারদের আমন্ত্রণে টাঙ্গাইল যান এবং সেখানে বসবাস শুরু করেন। শুরুতে তাঁতিরা নকশাবিহীন তাঁতের শাড়ি তৈরি করেন।
১৯০৬ সালে মহাত্মা গান্ধী স্বদেশি আন্দোলনের ডাক দেন। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ারের তৈরি কাপড় বর্জন করা। এ সময়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) তাঁতশিল্প প্রসার লাভ করে। ১৯২৩-২৪ সালে তাঁতের কাপড়ে নকশা প্রবর্তন করা হয়। ১৯৩১-৩২ সালে শাড়ি তৈরির জন্য জ্যাকার্ড তাঁত প্রবর্তন করা হয়। টাঙ্গাইল জেলার তাঁতবহুল গ্রামগুলো হচ্ছে বাজিতপুর, সুরুজ, বার্থা, বামনকুশিয়া, পাথরাইল, ঘারিন্দা, গোসাই, তন্দ্রি, নলুয়া, তারটিয়া, জোয়ার, এনায়েতপুর, দেওজান, বেলতা, গড়াসিন, সন্তোষ, নলসুন্দা, কাগমারি, বল্লা, রামপুর, বাংরা, সহদেবপুর, ভুক্তা, আকুয়া, ছাতিহাটি, আইসরা, রতনগঞ্জ, বিষ্ণুপুর ইত্যাদি। এসব গ্রামের তাঁতিরা বংশানুক্রমে যুগের পর যুগ ধরে বুনে আসছেন ঐতিহ্যের টাঙ্গাইল শাড়ি। অনেক পুরোনো একটা ঐতিহ্যের ধারায় চলছে এ কাজ। এভাবেই হাজার বছরের ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে শত প্রতিকূলতা ও প্রতিযোগিতাকে পেছনে ফেলেও স্বীয় ঐতিহ্য ধরে রেখে এই একবিংশ শতাব্দীতেও বাঙালি নারীর প্রথম পছন্দের তালিকায় রয়েছে টাঙ্গাইল শাড়ি। লোকমুখে একটি প্রচলিত কথা প্রায়ই শোনা যায়, ‘নদী চর খাল বিল গজারির বন/ টাঙ্গাইল শাড়ি তার গর্বের ধন।’
ঐতিহাসিকভাবে এ শাড়ির উৎপত্তিস্থল টাঙ্গাইল নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর প্রেক্ষাপট অনেকটাই পরিবর্তন হওয়ার পরই মূলত বিতর্ক শুরু হয়। টাঙ্গাইল শাড়ির মূল কারিগর বসাক সম্প্রদায়ের বড় অংশই দেশভাগের পর ভারতে চলে যান। পাকিস্তান পর্বে তো বটেই, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও বসাক সম্প্রদায়ের পরিবারের সংখ্যা ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে। তাঁরা মূলত নদীয়া জেলার ফুলিয়া এবং পূর্ব বর্ধমানের ধাত্রী ও সমুদ্রগড় এলাকায় বসবাস শুরু করেন। তাঁদের বদৌলতে নদীয়া ও পূর্ব বর্ধমানে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু উৎপত্তিস্থল টাঙ্গাইলের নাম ধারণ করার পরও ভৌগোলিকভাবে অন্য স্থানের পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায় কি না? জিআই হলো ভৌগোলিক নির্দেশক সনদ, যা উৎপাদককে উৎপাদিত পণ্যের ওপর স্বতন্ত্র অধিকার দেয়। অর্থাৎ, ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে এই পণ্যের একটা স্বীকৃতি। কিন্তু একটি দেশের নিজস্ব পণ্য শুধু কিছু কারিগরের অভিবাসী হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার কারণে পণ্যটির উৎপত্তিস্থল পাল্টে যায় না। টাঙ্গাইল শাড়ি ভৌগোলিক নির্দেশক ও গুণগত মান উভয় দিক থেকেই বাংলাদেশের পক্ষে যায়। টাঙ্গাইল শাড়ির যেহেতু টাঙ্গাইলেই উৎপত্তিস্থল, এখানেই উৎকর্ষ। এ স্থানের ভিত্তিতেই এটার স্বীকৃতি হওয়া উচিত।
কিন্তু টাঙ্গাইলের শাড়ির জিআই স্বত্ব হারানোর নেপথ্যে আমাদের দায় কি একেবারেই নেই? গণমাধ্যমের সূত্রে জানা যায়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্পনকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) নিশ্চিত করেছে, আজ রোববার পর্যন্ত টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের দপ্তর, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড বা বিসিকের (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন) পক্ষ থেকে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআইয়ের আবেদন জমা পড়েনি! যে পণ্যগুলো দুই দেশেই উৎপাদিত হয়, স্বাভাবিকভাবেই সেগুলোর স্বত্ব দেশগুলো নিজেদের নামে নিবন্ধন করতে চাইবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে জিআই স্বত্ব নিয়ে আইনি লড়াইয়ের বহু নজির আছে। বাংলাদেশের জনপ্রিয় পণ্যর জিআই স্বীকৃতি হাতছাড়া হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ‘পলিসিগত’ দুর্বলতা বলেই মনে করা হয়। তবে বাংলাদেশের সুযোগ একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি। এখনো এমন অনেক পণ্য আছে, যেগুলো বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশেই উৎপাদিত হয়, সেগুলোর জিআই স্বত্বের জন্য সবার আগে আবেদন করতে হবে। যেমন সাতকরার আচার বাংলাদেশের সিলেটেও হয়, আবার ভারতের আসামেও হয়। দিনাজপুরের লিচুকেও এই তালিকায় রাখা যাবে। এরপর আন্তর্জাতিক বাজার, যেমন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের জিআইভুক্ত পণ্যগুলো তালিকাবদ্ধ করতে হবে। তারপর যে পণ্যগুলোর জিআই স্বত্ব ভারত নিয়েছে, সেটা যে অযৌক্তিক, তার উপযুক্ত নথি-প্রমাণসহ জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও) বরাবর অভিযোগ করতে হবে। কারণ, জিআই স্বত্বের সঙ্গে যেহেতু পণ্যের মূল ভৌগোলিক উৎপত্তিস্থল জড়িত, তাই ভারতের পক্ষে কখনোই টাঙ্গাইলকে ভারতের অংশ হিসেবে প্রমাণের সুযোগ নেই। সেদিক বিবেচনায় আমাদের পক্ষেই রায় আসার কথা; যদিও কাজটা বেশ জটিল, ব্যয়সাপেক্ষ ও কঠিন।
দিন যত যাচ্ছে, বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ছে জিআই পণ্যের স্বত্বের গুরুত্ব। বিশ্বব্যাপী নিজস্বতা ব্যাপারটা অনেক বেশি আকাঙ্ক্ষিত। তাই বিশ্বব্যাপী জিআই পণ্যের চাহিদা অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় জিআই পণ্য এগিয়ে থাকে। এর দাম ২০ শতাংশ কখনোবা এরও বেশি হয় এবং জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর পণ্যগুলো রপ্তানি বাজার বেড়ে যায়। তাই ভবিষ্যতে আমাদের দেশীয় পণ্যগুলোর জিআই স্বীকৃতির ব্যাপারটি নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে। যেহেতু জিআই স্বত্ব প্রাপ্তি একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হয়, তাই যেসব সংস্থা কিংবা ব্যক্তির ওপর দায়িত্ব থাকবে, তাদের আরও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকতে হবে। সেই সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় যেন আবেদন বিলম্বিত বা বিঘ্নিত না হয়, সেদিকেও নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে খেয়াল রাখতে হবে। তবেই আমাদের দেশজ উৎপাদিত পণ্যকে আমরা বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড় করাতে পারব।
*লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]