দ্য বার্ডম্যান অব ইন্ডিয়া
সত্যজিৎ রায় ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিনেমার একটি দৃশ্যের জন্য এক বিশেষ নামের পাখি খুঁজছিলেন। এক বৃদ্ধ এসে সত্যজিৎ রায়কে বললেন, আপনি আসলে কোন পাখি খুঁজছেন।
সত্যজিৎ রায় বললেন, পাখির নাম হিমালয়ান বার্ড।
বৃদ্ধ বললেন, ওই নামের কোনো পাখি নেই।
সত্যজিৎ রায় বললেন, আছে।
বৃদ্ধ বললেন, আমি বলছি নেই এবং অবশ্যই নেই।
সত্যজিৎ রায় বৃদ্ধের দিকে তাকালেন। মুখে সাদা সাদা দাড়ি, গালটা ভাঙা, শরীরে দুই পয়সার শ্রী নেই। দেখলে মনে হয় পাগল। সত্যজিৎ রায় বিরক্ত হয়ে সহকারীকে বললেন, এই বুড়োকে সরিয়ে দাও।
সহকারী বুড়ো লোকটিকে শুধু সরিয়ে দিলেন না, গাড়িতে তুলে দিলেন। তারপর সত্যজিৎ রায়ের কাছে এসে বললেন, বুড়োটাকে সরিয়ে দিয়েছি।
এর কিছুক্ষণ পর সহকারী পরিচালক হন্তদন্ত হয়ে সত্যজিৎ রায়ের রুমে ঢুকে বললেন, ভারতবর্ষের খ্যাতিমান পক্ষিবিশারদ সালিম আলী আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি কোথায়?
সত্যজিৎ রায় বললেন, দেখতে কেমন?
বুড়ো, মুখে দাড়ি, গালটা ভাঙা।
সত্যজিৎ রায় লজ্জায় মাথা নিচু করে বললেন, তাঁকে তো পাগল মনে করে তাড়িয়ে দিয়েছি। কী লজ্জা!
সালিম আলীকে একবাক্যে মান্য করা হয় ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ পক্ষিবিশারদ হিসেবে। সালিম আলীর জন্ম ১৮৯৬ সালের ১২ নভেম্বর। ছোটবেলায় মা–বাবাকে হারিয়ে মামার আশ্রয়ে লালিত–পালিত হতে থাকেন। মামা আমিরুদ্দিন ছিলেন নামকরা শিকারি। ছোটবেলায়ই মামার কাছ থেকে একটি এয়ারগান উপহার পান। সেটা দিয়ে নানান ধরনের পাখি শিকার করে বেড়াতেন। তো একদিন একটু চড়ুই শিকার করে সেটা হাতে নিয়ে দেখেন তার গলায় হলদে দাগ, যা অন্য চড়ুইয়ের মাঝে দেখেননি। দৌড়ে মামার কাছে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, এই পাখিটা হালাল কি না। মামা নিজেও চিনতে পারেননি। তাঁকে পাঠিয়ে দেন বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির সেক্রেটারি ওয়াল্টার স্যামুয়েল মিলার্ডের কাছে। মিলার্ড তাঁকে পাখিটির আসল পরিচয় বলে দেন। মিলার্ড সালিম আলীকে তাঁর সংগ্রহে থাকা বিভিন্ন ধরনের পাখির স্টাফ করা দেহ দেখান। সোসাইটির ভেতরে দেয়ালজুড়ে মাউন্ট করা জীবজন্তু, শোকেসে সাজানো প্রজাপতি ও পাখির ডিম, দেয়ালে টানানো চিতাবাঘ-বাঘের মাথার খুলি প্রথমবার এসব দেখে সালিমের ছোট্ট মনে একরাশ বিস্ময় তৈরি হয়। তৈরি হয় কৌতূহল। সেই কৌতূহলই সালিমের জীবন বদলে দিয়েছিল।
শিক্ষাজীবন স্থগিত রেখে ১৯১৪ সালে সালিম মিয়ানমারে পাড়ি জমান পারিবারিক ব্যবসার প্রয়োজনে। সেখানে কাজের ফাঁকে অবসর সময়ে বাগানে পাখি দেখে সময় কাটাতেন। বিভিন্ন পাখির খুটিনাটি বর্ণনা নোটবুকে লিখে রাখতেন। ১৯১৭ সালে আবার ভারতে ফিরে আসেন অসমাপ্ত পড়াশোনা শেষ করতে। ১৯১৮ সালে বিয়ে করেন তাহমিনাকে।
এরপর সালিম আলী জার্মানি চলে যান। সেখান থেকে ১৯৩০ সালে ফিরে এসে পাখি পর্যবেক্ষণ আর গবেষণায় লেগে যান। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী তাহমিনা। তাঁর আগে সারা পৃথিবীতে পাখিবিষয়ক অধ্যয়ন ছিল মূলত চামড়া ছাড়িয়ে স্টাফ করে রাখা ও তার বৈজ্ঞানিক নাম, শরীরের মাপ, পালকের রং ইত্যাদি লিখে রাখা। সালিম আলীই প্রথম এর সঙ্গে পাখি যে পরিবেশে থাকে তার পরিচয়, পাখির আচরণ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদিকে অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন। বিশ্বের পাখিবিষয়ক গবেষকদের সামনে গবেষণার নতুন জানালা খুলে দেন।
সালিম আলীর ‘বুক অব ইন্ডিয়ান বার্ডস’ বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৪১ সালে। বইটি ভারতীয় পাখিদের সম্পর্কে রঙিন ছবিযুক্ত প্রথম ফিল্ড গাইড। মাঠে গিয়ে পাখি দেখার জন্য গাইড বইয়ের যে প্রয়োজন, সেই ধারণা ড. সালিম আলীর উদ্ভাবিত। নিজে বই লিখে তিনি নিজের ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মাঠে গিয়ে তিনি পাখিদের যেমন দেখেছেন, গতানুগতিক বর্ণনা ও মাপজোখের বাইরে পাখিদের পরিবেশ, স্বভাব, অভ্যাস, আচরণ ও জীবন ধারণের ওপর প্রচুর তথ্য এই বইতে পরিবেশন করেন।
প্রাণীদের সমীক্ষার সঙ্গে মূলত যুক্ত ছিলেন তিনি। বিশেষ করে বাবুই পাখির সামাজিক জীবন সম্পর্কে তাঁর গবেষণা ও মুক্ত ভাবনা স্পষ্টতার দিক দিয়ে জুলিয়ান হাক্সলির গবেষণার সঙ্গে তুলনীয়। জীবনে পুরোটা সময় পাখি নিয়ে গবেষণা করেছেন ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, যুক্তরাজ্যসহ নানা দেশে। পাখিদের নিয়ে লেখা তাঁর বিখ্যাত বই ‘বুক অব ইন্ডিয়ান বার্ডস’ (১৯৪১)। এ ছাড়া ডিলন রিপ্লির সঙ্গে তিনি ১০ খণ্ডের ‘হ্যান্ডবুক অব দ্য বার্ডস অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’ (১৯৬৮-৭৪) তাঁর সেরা কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। তিনি ‘ ফল অব আ স্প্যারো’ নামে আত্মজীবনী লিখে গেছেন।
সিডনি ডিলন রিপ্লির সঙ্গে তিনি পাখিদের পায়ে রিং পরানোর কাজ শুরু করেন। গবেষণাকাজে এর ভূমিকা অনেক। কিন্তু এটা করতে গিয়েও তিনি জটিলতার সম্মুখীন হন। অতীতে রিপ্লি সিআইএয়ের একটি সহযোগী সংস্থায় চাকরি করতেন। তাঁদের দুজনের নামে অভিযোগ ওঠে যে তাঁরা যে পাখির পায়ে রিং পরান তা সিআইএয়ের একটি পরিকল্পনা অংশ।
তিনি ১৯৫৮ সালে পদ্মভূষণ এবং ১৯৭৬ সালে পদ্মবিভূষণ খেতাব লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি মারা যান। তাঁকে ডাকা হয় ‘দ্য বার্ডম্যান অব ইন্ডিয়া’ নামে।
পাখির পাশাপাশি আরেকটি জিনিস তিনি খুবই ভালবাসতেন—মোটরসাইকেল। ১৯৫০ সালে সুইডেনের আপসালাতে পক্ষিবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি সানবিম মোটরসাইকেল চালিয়ে যান, তখন তাঁর বয়স ছিল ৫৪। মোটরসাইকেলটি তিনি বোম্বে থেকে জাহাজে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, ওই বাইকে তিনি পুরো ইউরোপ ঘুরে বেড়াবেন। সত্যি সত্যি তিনি ইউরোপের অনেক দেশ ঘুরে বেড়ান ওই মোটরসাইকেলে করে। তাঁর সংগ্রহে ছিল হার্লে ডেভিডসনের ৩টি মডেল। এ ছাড়া একটা করে ডগলাস, স্কট, নিউ হাডসন ও জেনিথ মোটরবাইক চালিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে।
ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট—পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ছিলেন তাঁর দূরসম্পর্কের কাজিন এবং তাঁর ছোটবেলার খেলার সাথি।
কলেজে পড়ার সময়ে ড. সালিম আলীকে নিয়ে পত্রিকায় একটি নিবন্ধ পড়েছিলাম। সেই থেকে পাখির প্রতি আমার ভালোবাসা আরও বেড়ে যায়। পাখি দর্শনের বিষয়ে তিনি আমার আদর্শ৷ পাখি দেখা দারুণ একটি শখের ব্যাপার। সালিম আলী বলেছেন, "People say you cannot make a living from bird watching. That is perhaps true, but, it is also true that man does not live by bread alone. Just look at the people who have no such hobbies and spend all their time solely on earning a living. After 60, when they retire from the official chair, they don’t know what to do with all their time in their hands, and just spend it watching the clock! If they had cultivated a hobby like bird watching, perhaps they would have lived longer to enjoy their pension”.
গতকাল ছিল এই মহামানবের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন ‘দ্য বার্ডম্যান অব ইন্ডিয়া’।
সূত্র :
১. ড. মোহাম্মদ আমীন, বিখ্যাতদের কৌতুক, হাস্যরস ও প্রজ্ঞাযশ (প্রকাশনীয়, পৃষ্ঠা- ২৮০)
২. Remembering India’s Birdman, The Hindu (12 November, 2020)
৩. Salim Ali : India’s Birdman, lover of nature (11 November, 2019)
৪. পাখি দেখার নেশায়, উর্মী নাথ, আনন্দবাজার পত্রিকা (১১ নভেম্বর, ২০২০)
৫. Dr. Salim Ali : Birdman of India, 1896-1987, Nature and Safari India.
৬. ভারতবর্ষের পাখিবিজ্ঞানী সালিম আলীর পাখিচর্চা, ডেইলি বাংলাদেশ, (২৯ এপ্রিল ২০১৮)।
লেখক: সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও বার্ড ফটোগ্রাফার
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]