এ ভোগান্তির শেষ কোথায়?
সকালে কাঁচাবাজারে গিয়েছিলাম। সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজারের তালিকা অনুযায়ী বাজার করতে একটু সময় লেগেছে। কারণ, সব দোকানে ঘুরে যেখানে একটু কম দামে কাঁচাবাজার পাওয়া যায় সেখানে কিনতে হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো আমাকে তো সকাল ১০টার কলেজে এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হবে। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে ৯টা বাজে। দ্রুত হেঁটে গিয়ে বাসায় রাখব তার উপায় নেই। কারণ, হাতে বাজারের ভারী ব্যাগ। হঠাৎ সামনে এক খালি রিকশা দেখতে পেয়ে ডাকলাম, চাচা! নতুন হাট দেওয়ানপাড়ায় যাব। আপনি যাবেন? তিনি কথা না বলে, ইশারায় বলে দিলেন তিনি যাবেন।
রিকশায় উঠেই তাঁকে প্রশ্ন করায় জানতে পারলাম, তিনি জয়পুরহাট সদর উপজেলার খঞ্জপুর এলাকায় থাকেন। নাম তাঁর মোজাম্মেল। তিনি শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে রিকশা চালান। ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। তিনি ও একমাত্র স্ত্রী মিলে বর্তমানে তাঁর সংসার। তাঁকে প্রশ্ন করলাম চাচা, এক দিনে আপনি কত টাকা আয় করেন? এমন প্রশ্ন করামাত্রই রিকশার পেছন থেকে কেউ লাঠি দিয়ে জোরে আঘাত করল বলে মনে হচ্ছে। তবে হঠাৎ এমন আঘাতের শব্দ শুনে ভয় পাওয়ার কথা, কিন্তু আমি ও রিকশাচালক চাচা দুজনের মধ্যে কেউ ভয় পাইনি।
কারণ, এমন আঘাত ট্রাফিক পুলিশ প্রতিদিন দেয়। একটু তাকিয়ে দেখি জয়পুরহাট শহরের প্রধান রাস্তায় রেলগেট এলাকায় রিকশা, মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস ও বাস। রাস্তার কানায় কানায় ভরে গেছে। এ যেন রাজধানী ঢাকা শহরকেও হার মানিয়েছে। পা ফেলার জায়গা নেই। চাচার জীবনের গল্প তো সমাপ্ত হলো না। নিজের জীবন যানজটের গল্প গেল। ভাদ্রের প্রচণ্ডের গরমে রিকশায় চড়ে গাড়ির হুইসেলের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম চাচা ইটপাথরের শহর দেখে এত গাড়ি দেখে তো দেশের উন্নয়ন হয়েছে বলে মনে হয় কিন্তু ৫ মিনিটের রাস্তা পার হতে ২০ মিনিট লাগে কেন? তিনি উত্তরে বললেন, যানজট মানেই উন্নয়ন! চাচার এমন কথা শুনে একটু আশ্চর্য হলাম। তাঁকে বললাম, চাচা আপনি তো অদ্ভুত কথা বললেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ অদ্ভুত মনে হলেও সত্য, কোনো একদিন আমি টেলিভিশনে এক নেতার ভাষণে শুনেছি যানজট মানে নাকি উন্নয়ন।
পরে ভাবলাম, চাচা তো ঠিক বলেছেন। কারণ, গত ৬ এপ্রিল জাতীয় সংসদে রাজধানীর যানজট নিয়ে এক সংসদ সদস্যের সমালোচনার জবাবে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। তাই সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি বেড়েছে। আওয়ামী লীগ আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় এলে উপজেলা পর্যায়েও যানজট হবে। মন্ত্রীর এই মন্তব্যে বোঝা যায়, তিনি যানজটকে উন্নয়নের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করছেন। এমন অদ্ভুত উন্নয়ন পৃথিবীর আর অন্য কোনো দেশে আছে বলে আমার জানা নেই। তবে একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে জয়পুরহাট শহরের প্রধান সড়কের রামদেও বাজলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় সামনে চার লেনে প্রশস্তকরণ প্রকল্পের কাজের ভিত্তিপ্রস্তরের ফলকটি দৃশ্যমান হচ্ছে।
এমন উন্নয়নকাজ দেখে জয়পুরহাট শহরবাসী আনন্দে উল্লাস করেছিল। কাশেম ময়দানে নেতাদের উন্নয়নের কথার মালা তৈরি হয়েছে। সংবাদকর্মীদের ফটোসেশনের দৌড়াদৌড়ি। সংবাদমাধ্যমে খবর ছাপা হয়েছে, জয়পুরহাটের মানুষ পাবে স্বপ্নের চার লেনের মহাসড়ক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, চার লেনের মহাসড়কের কাজ যেন চলছে মহাশম্বুকগতিতে। সাধারণ মানুষের অপেক্ষার প্রহর কবে শেষ হবে? জেলা শহরের আড়াই কিলোমিটার সড়ক ফোর লেন হবে, যাতে করে এ শহরে আর যানজট থাকবে না। এমন আশার গুড়ে যেন বালি। কারণ, গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে চার লেনে সড়ক প্রশস্তকরণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। সড়ক বিভাগ জয়পুরহাটের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের হালনাগাদ তথ্যের প্রতিবেদন বলা হয়, চার লেন সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের ১.২৭৯৩ একর ভূমি অধিগ্রহণে ৯০ কোটি ২০ লাখ, ৮৫ হাজার ৯৮০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। পানির লাইনের জন্য জয়পুরহাট পৌরসভাকে দিয়েছে ১ কোটি ৪৯ লাখ ৬৭ হাজার ৩২৪ টাকা। জয়পুরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে দিয়েছে ৪৪ লাখ ৬ হাজার ৫৭৭ টাকা। নেসকোকে দিয়েছে ২ কোটি ৯৭ লাখ ৭৮ হাজার ৬৩৪ টাকা। বিটিসিএলে দিয়েছে ২ কোটি ৯২ লাখ ৬১ হাজার ৫৬০ টাকা। রেলওয়ে দিয়েছ ৬ কোটি ১৭ লাখ ১৮ হাজার ৫১৪। এত কিছু হিসাব–নিকাশ হলো কিন্তু কত সেপ্টেম্বর এল আর গেল! চার লেনের রাস্তার একটি ইট কিংবা পাথরে দানায় বিছানো হয়নি। ঢাকঢোল পেটানো এই মহা উন্নয়নের মহাসড়কের কাজের শুরু কিংবা গতি নেই কেন? এ প্রশ্নের উত্তরেই কে দেবে?
এই চিত্র শুধু জয়পুরহাটে নয়, কয়েক বছর ধরে বাজেটে সড়ক যোগাযোগ খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে আসছে সরকার। ফলে এটা স্পষ্ট যে যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বেশ সুখবর হলেও বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে ভিন্ন কিছু। একাধিক আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশে আন্তর্জাতিক মানের কোনো সড়ক-মহাসড়কই নেই। অথচ অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্তই হলো মানসম্পন্ন যোগাযোগব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে আমরা কেন পিছিয়ে আছি, এত বাজেটের টাকা যায় কোথায়? এর উত্তর কে দেবে?
জাতির ক্রান্তিলগ্নে সড়কপথগুলো সংস্কারে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা বন্ধ করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সড়ক-মহাসড়ক টেকসই করতে হলে সবার আগে দুর্নীতি দমন করতে হবে। পাশাপাশি সনাতন ধারার পদ্ধতি পরিবর্তে করে সড়কের টেকসই উন্নয়ন ঘটানো যায়, এমন গবেষণা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণকাজে সংশ্লিষ্ট সব সরকারি প্রতিষ্ঠান কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। নিম্নমানের ইট, বালু ও খোয়া দিয়ে সড়ক নির্মাণ করতে না পারে এবং সড়কের কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা তদারকির জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে হবে। প্রকল্পের কাজে দরপত্রে টেকনিক্যাল ফিন্যান্সিয়াল অফার মূল্যায়নে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের চাপ থেকে প্রকৌশলীদের সুরক্ষা দিতে হবে। নির্মাণকাজে গাফিলতি ও ঠিকাদার নিয়োগে নীতিমালা লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক: রাশেদুজ্জামান রাশেদ, প্রাবন্ধিক