শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কি ব্যর্থ হয়ে যাবে
দেশে নিরাপদ ও জনবান্ধব সড়ক পরিবহনব্যবস্থা গড়েই উঠছে না। তেমন কোনো লক্ষণও দৃশ্যমান নয়। সড়কে গণপরিবহন যেমন চলছে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে, তেমনি অধিকাংশ ব্যক্তিগত যানবাহন চলছে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে। ফলে অহরহ সড়ক দুর্ঘটনা, গণপরিবহনে যাত্রী হয়রানি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ইত্যাদি নিত্যদিনের দুর্ভাগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়গুলো যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। দেশে বড় ধরনের কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে কিংবা কোনো দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে জনবিক্ষোভ তৈরি হলে সরকার সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে তৎপরতা দেখায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নানা রকম প্রতিশ্রুতি দেন, কমিটি গঠন করেন, বৈঠক করেন, সুপারিশমালা তৈরি করেন। অতঃপর এসব তৎপরতার মধ্যেই আরেকটি ঘটনা ঘটলে মানুষের মনোযোগ সরে যায়, সেই সুযোগে কর্তৃপক্ষের তৎপরতাও থেমে যায় এবং বিরামহীনভাবে ঘটতে থাকে দুর্ঘটনা, চলতে থাকে নানা রকম অনিয়ম। এভাবেই চলছে দেশের সড়ক পরিবহনব্যবস্থা।
সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনায় চলমান এমন নানা নৈরাজ্যের মধ্যে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বেপরোয়া বাসের চাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ২ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়। এ ঘটনায় ঢাকাসহ সারা দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে। সে এক অভূতপূর্ব অহিংস আন্দোলন। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান দিয়ে শিক্ষার্থীরা সড়কে-যানবাহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে, দেশে প্রথমবারের মতো ইমার্জেন্সি লেন তৈরি করে সারা দুনিয়ায় প্রশংসিত হয়। তারা যানবাহনের ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা শুরু করলে দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির যানবাহন আটকে যায়। শিক্ষার্থীদের সেই অহিংস স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন আমাদের দেখিয়েছিল সড়ক পরিবহন খাতের দায়হীন, মায়াহীন সংকটাপন্ন চেহারা। ব্যাপক জনসমর্থিত সেই আন্দোলন চলাকালে সরকার শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি মেনে নিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানায়। শিক্ষার্থীরা সরকারের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যায়, কিন্তু সড়কে আর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হয়নি। তবে শিক্ষার্থীদের এমন আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ দ্রুততার সঙ্গে সংসদে পাস করে। দেশবাসী প্রত্যাশা করেছিল নতুন আইনের মাধ্যমে দেশের সড়ক পরিবহনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু হয়নি। কারণ, এখনো আইনটির বাস্তবায়নই শুরু হয়নি। এটি সরকার এবং রাষ্ট্রের সদিচ্ছার অভাবকেই দৃশ্যমান করে তোলে।
অবাক ব্যাপার হলো, সড়ক পরিবহন আইন সংসদে পাস করার কয়েক মাস পরই ২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল’ এক সংসদ সদস্যকে প্রধান করে ‘সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ কমিটি’ নামে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ১১১টি সুপারিশ তৈরি করে ওই বছরের ২২ আগস্ট সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর কাছে জমা দেয়। সেই সুপারিশসমূহে নতুন কিছু ছিল না, পুরোনো কথাই নতুন করে লেখা হয়েছিল। সেখানে পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের প্রতি কোনো নির্দেশনা ছিল না, চাঁদাবাজি বন্ধেও ছিল না কোনো পরামর্শ। শুধু জনসচেতনতা ও অবকাঠামোগত বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সরকার আবার টাস্কফোর্স গঠন করে। অর্থাৎ শুধু কমিটি আর কমিটি। অবশ্য সেই সুপারিশগুলোও বাস্তবায়ন হয়নি। সংসদে পাসকৃত একটি পূর্ণাঙ্গ আইন বাস্তবায়ন না করে কেন আবার নতুন কমিটি গঠন এবং সুপারিশ তৈরি করা হলো? এটি একটি বড় প্রশ্ন। এসব উদ্যোগ ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ বা অনীহারই নামান্তর।
সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ তে জামিন অযোগ্য ধারা, সাজা ও জরিমানা বৃদ্ধির বিধান থাকায় পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা শুরু থেকেই আইনটি বাস্তবায়নে আপত্তি করতে থাকেন। আসলে পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে রাখাকে বা ভাবতে পছন্দ করেন। তাঁরা সব সময় জোর করে, ধর্মঘটের মাধ্যমে মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায় করতে চান। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক আচরণ!
পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। তাঁরা পরিবহন সেবার মাধ্যমে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনব্যবস্থা সচল রাখেন। তাই আমরা পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির বিরুদ্ধে নই। কোনো অন্যায্য আইন তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতীও নই। কিন্তু মালিক-শ্রমিক নেতৃবৃন্দকে স্পষ্ট যুক্তি দিয়ে বলতে হবে, আইনটি বাস্তবায়ন হলে কোন বিধানগুলো তাঁদের পেশাগত অধিকারকে ক্ষুণ্ন করবে, জীবনকে বিপন্ন করবে। এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে তাঁদের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের দরকার নেই, সব পক্ষের অংশগ্রহণে আলোচনা হতে হবে। পরিবহনমালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি, সড়ক নিরাপত্তা ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ, সড়ক ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধি, সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনসমূহের প্রতিনিধি এবং সরকার—সবাই একসঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছে আইনটির বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। সাজা ও জরিমানার পরিমাণ যা-ই নির্ধারিত হোক না কেন, তা বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে আমরা আইনে জামিন অযোগ্য ধারা চাই না। কারণ, এটা আইনের মৌলিক নীতি বিরোধী এবং মানবাধিকার পরিপন্থী। জামিন পাওয়া একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনি অধিকার। আমরা চাই সহনীয় আইন, কিন্তু কঠোর বাস্তবায়ন। কারণ, বাস্তবায়ন না হলে আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান থেকেই লাভ কী? আইন মেনে পরিবহনমালিকেরা সুষ্ঠুভাবে তাঁদের ব্যবসা পরিচালনা করবেন, শ্রমিকেরা নিরাপদে তাঁদের পেশাগত জীবন নির্বাহ করবেন—এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কোনো অবস্থাতেই নৈরাজ্য সমর্থন করা যায় না। বিভিন্ন ধারা ও বিধানের বিষয়ে আপত্তি তুলে অনির্দিষ্টকালের জন্য আইনটি অকার্যকর করে রাখার কোনো যুক্তি নেই, অধিকারও নেই।
সড়ক-মহাসড়কে অসহনীয় যানজট, গণপরিবহন যাত্রীবান্ধব ও সহজলভ্য না হওয়া ইত্যাদি কারণে নগরে, শহরে ও গ্রামে মোটরসাইকেল ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীদের বড় অংশ কিশোর-যুবক। এদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে ইদানীং সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে রাজনৈতিক মোটরসাইকেল সংস্কৃতিও বেড়েছে। এসব মোটরসাইকেলের চালক ছাত্র-যুবরা আরও বেপরোয়া। মোটরসাইকেল বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপনে যেসব ভাষাভঙ্গি ব্যবহার করে, তা খুবই উচ্ছৃঙ্খল এবং অসচেতনতামূলক।
সারা দেশে ব্যাটারিচালিত স্বল্পগতির ইজিবাইক, অটোরিকশা, স্থানীয়ভাবে তৈরি নছিমন, ভটভটি, আলমসাধু, মাহিন্দ্র, বোরাক, টমটম, চান্দের গাড়ি ইত্যাদি ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলছে। গ্রামে-শহরে স্বল্প দূরত্বে চলাচল এবং পণ্য পরিবহনে এসব যানবাহন ব্যবহৃত হয়। কিন্তু মহাসড়কের পাশ দিয়ে সার্ভিস রোড না থাকায় এসব যানবাহন বাধ্য হয়ে মহাসড়ক ব্যবহার করছে এবং অহরহ দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে।
এই হলো দেশের সড়ক পরিবহনব্যবস্থার নাজুক চিত্র। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা নজিরবিহীন আন্দোলনকে ঘিরে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় যে পরিবর্তনের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা দানা বেঁধেছিল, তা ফিকে হয়ে গেছে। প্রত্যাশা ছিল এই আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় বিবেক জাগ্রত হবে। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ কঠোর হবে। ব্যক্তিগত যানবাহনের মালিকসহ গণপরিবহনের মালিকেরা দায়িত্বশীল হবেন, চালক-শ্রমিকেরা সচেতন হবেন। সড়ক ব্যবহারকারী ছাত্র-যুবসহ সর্বসাধারণও সচেতন হবেন। দেশে একটি টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল প্রণীত হবে এবং আইনকানুন ও নীতি-নৈতিকতার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। এভাবে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সড়কে লাশের মিছিল ক্রমেই ছোট হবে। যানবাহনের চাকায় মানুষের স্বপ্নভঙ্গের বুকফাটা আর্তনাদ ও হাহাকার বন্ধ হবে। কিন্তু কিছুই হলো না, বরং ক্রমেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। তাই প্রশ্ন জাগছে, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কি ব্যর্থ হয়ে যাবে?