সাগর থেকে পাহাড় পর্যন্ত পর্যটনই কি কক্সবাজারের শেষ ঘণ্টা

সৈকতে ছাতার নিচে কিটকট চেয়ারে বসে সমুদ্র দেখতে ভালোবাসেন পর্যটকেরা। কক্সবাজার সৈকতের কলাতলী পয়েন্টেছবি–প্রথম আলো

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কক্সবাজার ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি কৌশলগত সামরিক ঘাঁটি। এখানে নির্মাণ করা হয়েছিল অস্থায়ী বিমানঘাঁটি, সেনা ছাউনি ও রসদ সরবরাহের কেন্দ্র। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার যুদ্ধ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা এ অঞ্চলটি পরিণত হয়েছিল এক সামরিক করিডরে।

যুদ্ধ শেষ হলেও কক্সবাজারের অবস্থানগত গুরুত্ব কখনোই হারায়নি; বরং আজকের তথাকথিত উন্নয়ন—পর্যটন, বন্দর, করিডর, রেল ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্পগুলো আবারও এই অঞ্চলকে নতুনভাবে ভূরাজনৈতিক আধিপত্যের নাট্যমঞ্চে দাঁড় করিয়েছে এবং এই আধিপত্যের মোড়কে লুকানো আছে প্রকৃতি, মানুষ, পানি ও জীবিকার নিঃশব্দ ধ্বংস।

একসময় কক্সবাজার ছিল একটি জীবন্ত অঞ্চল, যেখানে পাহাড়, খাল, সমুদ্র, লবণ চাষ, কৃষি ও মৎস্যজীবনের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক সখ্য গড়ে উঠেছিল। আজ সেসব প্রকৃতি ও পেশা পর্যটনের চাপ ও প্রকল্পনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। খাল ভরাট, বালিয়াড়ি কেটে হোটেল নির্মাণ, কৃষিজমি রূপান্তর আর মানুষের উচ্ছেদের মাধ্যমে শহরটি হয়ে উঠছে এক ‘প্রকল্পনির্ভর, জীবিকা–বিচ্ছিন্ন ও পানি–সংকটময় শোপিস’।

ডলফিন মোড়: নাম দিয়ে ধ্বংস ঢাকার প্রতীক

‘ডলফিন মোড়’ নামটি যেমন আকর্ষণীয়, বাস্তবে ততটাই নির্মম। একসময় এই এলাকায় ছিল খাল ও কৃষিজমি। এখন সেখানে হোটেল, ট্রাফিক, শব্দ আর বিলবোর্ড। ডলফিন নেই, খাল নেই; নেই প্রকৃতির ছায়াও। এটা আসলে নাম ও উন্নয়নের নামে প্রকৃতি ধ্বংসের ছদ্মবেশ, যা কক্সবাজারজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।

পানির সংকট: পর্যটনের বিলাসিতা বনাম জনগণের বেঁচে থাকা

হাজারো হোটেল–রিসোর্ট প্রতিদিন লক্ষাধিক লিটার ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছে। এতে পানির স্তর নিচে নামছে, আর তৈরি হচ্ছে saltwater intrusion; অর্থাৎ সমুদ্রের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করছে মাটির নিচে। এতে শুধু কৃষির ব্যবস্থাই বিপর্যস্ত হচ্ছে না, সাধারণ মানুষ শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে, যখন পর্যটকেরা বিলাসবহুল রিসোর্টের বাথটাবে পানিতে ডুবে থাকেন।

পানি আইন ২০১৩ ও সংবিধানের ১৮–ক অনুচ্ছেদ বলছে, পানি জনগণের মৌলিক অধিকার। কিন্তু এখানে পর্যটনের জন্য সেই অধিকার আজ হুমকির মুখে।

বিগ–বি, বন্দর ও আধিপত্যের ছায়া

জাপানের BIG-B (Bay of Bengal Industrial Growth Belt) প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারে গড়ে উঠছে গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও রেলপথ। এই প্রকল্পগুলো আপাতদৃষ্টে উন্নয়ন মনে হলেও বাস্তবে এগুলো গড়ে তুলছে একটি জ্বালানি ও বাণিজ্য করিডর, যার সুবিধা পাচ্ছে বিদেশি বাণিজ্যিক শক্তি আর মূল্য দিচ্ছে স্থানীয় জনগণ। উচ্ছেদ, পানির সংকট, প্রকৃতির ক্ষতি ও পুরোনো সংস্কৃতি মুছে যাওয়া যেন এখন একটি স্বাভাবিক ঘটনা।

নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

সেন্ট মার্টিন: পর্যটনের ঋতুভিত্তিক প্রতারণার জ্বলন্ত উদাহরণ

সেন্ট মার্টিন ছিল কৃষিনির্ভর ও স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দ্বীপ; ছিল খাল, পুকুর, কৃষিজমি, নারকেলের বাগান, মাছের জাল ও নিজের হাতে গড়া জীবনচক্র। কিন্তু আজ পর্যটনের কারণে সে দ্বীপ পরিণত হয়েছে ঋতুভিত্তিক এক খাদ্য ও পানির দুর্ভিক্ষে। পর্যটনের মৌসুমে দ্বীপজুড়ে লোকের ভিড়, হোটেল, ট্যাংকার আর মৌসুম শেষ হলেই সেই দ্বীপে ধীরে ধীরে নেমে আসে নীরব সংকট।

কৃষিজমি হারিয়ে গেছে, খাল ভরাট, পানি লবণাক্ত ও মাছের ঘাট দখল। এখন মানুষকে খাবার আনতে যেতে হয় দ্বীপ থেকে বাইরে, পানি আসে জাহাজে, আর কাজের খোঁজে ছাড়তে হয় দ্বীপ। সেন্ট মার্টিন এখন আর শুধু দ্বীপ নয়, একটি সতর্কবার্তা! এক মৃত্যুপুরী মডেল, যেখানে পর্যটন এক ঋতুভিত্তিক প্রতারণা।

ধ্বংসের আগে একটা শেষ ঘণ্টা বেজে ওঠে। কক্সবাজারে সেই ঘণ্টাটিই এখন বাজছে পর্যটনের নামে। আমরা যদি এখনো না থামি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমরা রেখে যাব শুধু গল্প—এই উপকূলে ছিল নদী, খাল, মাছ, বাঁশের নৌকা আর একটুকরা প্রাকৃতিক জীবন। তাদের আর কিছু থাকবে না; থাকবে শুধু দখল, কংক্রিট আর একচিলতে বিজ্ঞাপনসজ্জিত শব।

এই প্রশ্ন এখন সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে, ‘এই পর্যটনই কি কক্সবাজারের শেষ ঘণ্টা?’

*লেখক: মো. জাবেদ নূর শান্ত, প্রতিষ্ঠাতা, ক্লাইমেট জাস্টিস বাংলাদেশ